মাহুত খুনের দায়ে হাতির ফাঁসি কার্যকর করায় মার্কিন শহরের বাসিন্দারা অনুতপ্ত
১২ সেপ্টেম্বর, ১৯১৬, খেলা দেখানোর দিন নতুন মাহুত এলড্রিজকে হয়তো মেনে নিতে পারেনি মেরি। ফলে খেলা দেখানোর সময় এলড্রিজের নির্দেশেও তেমনভাবে সাড়া দিচ্ছিল না সে। বিপাকে পড়ে মেরির মাথায় রডের খোঁচা দিয়ে তাকে বাগে আনার মরিয়া চেষ্টা চালায় এলড্রিজ। আর এতেই মেজাজ হারায় মেরি। এলড্রিজকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে মাটিতে আঁছাড় মারে মেরি। পা দিয়ে পিষে দেয় এলড্রিজের মাথা। ঘটনাস্থলেই মৃতু্য হয় এলড্রিজের। চোখের সামনে এই ঘটনা দেখে আতঙ্কে সার্কাসের তাবু ছেড়ে পালিয়ে যান দর্শকরা
প্রকাশ | ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
আইন ও বিচার ডেস্ক
খুনের অপরাধে হাতিকেও ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে এ শহরে। ১০০ বছর পেরিয়ে আজও 'নজিরবিহীন' সেই ঘটনা। মাহুতকে খুনের অপরাধে হাতির ফাঁসি দেওয়া হয় সে সময়ের শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্কাসের অন্যতম আকর্ষণ 'মেরি' নামের একটি হাতিকে। আজও অপরাধ বোধ যেন কুঁড়ে কুঁড়ে খায় এই মার্কিন শহরের প্রতিটি বাসিন্দাকে। ১৯১৬ সালে পৃথিবীর সার্কাসের ইতিহাসে বিরলতম এই ঘটনাটি ঘটেছিল আমেরিকার অঙ্গরাজ্য টেনেসির এরউইন শহরে।
মেরির গল্প বলতে গেলে একজনের নাম নিতেই হবে। তিনি হলেন, চার্লি স্পাইকস। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মাত্র ৮ বছর বয়স থেকে সার্কাসে খেলা দেখাতেন শুরু করেন চার্লি। এই সময় চার্লির বাবা চার বছর বয়সি ছোট্ট মেরিকে কিনে আনেন। অল্প কয়েকদিনের মেরির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে যায় চার্লির। বছরখানেকের মধ্যে চার্লি আলাদা একটি সার্কাস তৈরি করেন। সেটির নাম ছিল স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শো। এই সার্কাসে খেলা দেখাতে শুরু করে মেরি। দেখতে দেখতে স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শো-এর অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে মেরি। নাম বদলে গিয়ে মেরি তখন 'বিগ মেরি' হয়ে গিয়েছে। মেরি ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমতি এশীয় প্রজাতির বিশালাকার হাতি। নিঃসন্তান স্পার্কস ও তার স্ত্রী অ্যাডি মিচেল নিজেদের সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন মেরিকে। মেরির দেখভালের জন্য একটি মাহুত ছিল বটে, তবে চার্লির কথাই বেশি মানতো সে।
স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শো এবং মেরির বুদ্ধিদীপ্ত কলাকুশলের খবর দ্রম্নত আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে ভার্জিনিয়ায় খেলা দেখানোর বরাত পায় স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শো'তে।
ভার্জিনিয়ায় যাওয়ার আগেই কোনো এক অজানা কারণে মেরির পুরনো মাহুত কাজ ছেড়ে চলে যায়। সার্কাসের দল পৌঁছায় ভার্জিনিয়ায়। ভার্জিনিয়ার সেইন্ট পল এলাকায় তাবু পড়ে স্পার্কস ওয়ার্ল্ড ফেমাস শো-এর। এই সময় মেরির মাহুত হওয়ার জন্য তার ট্রেইনার পল জ্যাকোবের কাছে আবেদন জানান স্থানীয় একটি হোটেলের কর্মচারী ওয়াল্টার রেড এলড্রিজ। নাছোড় এলড্রিজের আবদার রেখে চার্লি তাকে হাতির দেখভালের দায়িত্বে নিয়োগ করেন। এলড্রিজকে হাতি দেখভালের যাবতীয় নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দেওয়া হয়।
১২ সেপ্টেম্বর, ১৯১৬, খেলা দেখানোর দিন নতুন মাহুত এলড্রিজকে হয়তো মেনে নিতে পারেনি মেরি। ফলে খেলা দেখানোর সময় এলড্রিজের নির্দেশেও তেমনভাবে সাড়া দিচ্ছিল না সে। বিপাকে পড়ে মেরির মাথায় রডের খোঁচা দিয়ে তাকে বাগে আনার মরিয়া চেষ্টা চালায় এলড্রিজ। আর এতেই মেজাজ হারায় মেরি। এলড্রিজকে শুঁড়ে পেঁচিয়ে মাটিতে আঁছাড় মারে মেরি। পা দিয়ে পিষে দেয় এলড্রিজের মাথা। ঘটনাস্থলেই মৃতু্য হয় এলড্রিজের। চোখের সামনে এই ঘটনা দেখে আতঙ্কে সার্কাসের তাবু ছেড়ে পালিয়ে যান দর্শকরা।
এই খবর দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। প্রায় সবকটি স্থানীয় পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও শুরু হয়ে যায় মেরিকে নিয়ে। চার্লি সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, সে দিনের ঘটনায় দোষ মেরির নয়, এলড্রিজের। কিন্তু চার্লির কথা তখন কেউ শুনতে রাজি হয়নি। শহরের বেশিরভাগ মানুষ একজোটে মেরিকে 'মৃতু্যদন্ড' দেওয়ার সিদ্ধান্তে অবিচল রইলেন। অবশেষে ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১৬-এ মেরির মৃতু্যদন্ড কার্যকর করতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেন নিয়ে আসা হল। ক্রেনের শেকল শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হলো মেরির গলার সঙ্গে।
নির্দেশ পেতেই একটানে মেরিকে মাটি থেকে প্রায় বিশ ফুট উপরে ঝুলিয়ে দিল ওই ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেনটি। কিন্তু প্রথমটায় ক্রেনের শিকল ছিঁড়ে মাটিতে আঁছড়ে পড়ে প্রায় ৫ টন ওজনের মেরি। মেরুদন্ড ভাঙল, পাঁজর ভাঙল, গলার কাছে চামড়া-মাংস ছিঁড়ে রক্ত পড়তে লাগল।
কিন্তু তাতেও শান্ত হলো না সেখানে উপস্থিত কয়েকশ' মানুষ। গলায় শেকল বেঁধে ফের মেরিকে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। ছটফট করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যে মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়ে মেরি।
সে দিন যে শহর ওই দুর্ঘটনার জন্য মেরিকে খুনের অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল, ঘটনার ১০০ বছর পেরিয়ে তারাই হাতি সংরক্ষণের নানা উদ্যোগে শামিল হচ্ছে। মেরিকে স্মরণ করে প্রতি বছর বিশেষ তহবিল গড়ে হাতির দেখভালের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করছে। এ সবের মধ্যে দিয়ে এরউইন শহরের বর্তমান নাগরিকরা যেন ১০০ বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষের করা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছে।
এরউইনের নতুন প্রজন্ম চায়, এ শহরের পরিচয় আর যেন হাতিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর মতো কোনো 'নজিরবিহীন' বর্বর ঘটনার সঙ্গে জুড়ে না থাকে। পশুপ্রেম আর মানবতার নতুন পথে হেঁটে পুরনো কলঙ্ক মেটাতে বদ্ধ পরিকর তারা।