গণতন্ত্র সুসংহত করতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। সাংবিধানিক সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সময় যে বিভিন্ন রকমের নির্বাচন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়, তার প্রতিটির জন্য রয়েছে পৃথক আইন। যেমন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য রয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২।
প্রতিটি নির্বাচনে প্রার্থী ও ভোটারদের জন্য নির্বাচন কমিশন কিছু আচরণবিধি তৈরি করে দেয়, যার লঙ্ঘন হলে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী বা ভোটারকে সাজা দিতে পারে কমিশন। নির্বাচন কমিশনের এ বিধিমালার পাশাপাশি নির্বাচনসংক্রান্ত বেশ কিছু ফৌজদারি অপরাধের বিধান বলা আছে আমাদের পেনাল কোডের ৯(ক) অধ্যায়ে। নির্বাচন সে যে রকমেরই হোক না কেন, পেনাল কোডের এ বিধানগুলো প্রতিটিতেই কার্যকর হবে। প্রার্থী কিংবা ভোটার প্রত্যেকের উচিত, এ অপরাধগুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখা।
ভোটাধিকার কী? :পেনাল কোডের ১৭১(ক) ধারায় ভোটাধিকার বলতে বোঝানো হয়েছে একজন ব্যক্তির নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া কিংবা না হওয়ার অধিকার, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের অধিকার এবং সর্বোপরি ভোট দেওয়া কিংবা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার অধিকার। সুতরাং, ভোট দেওয়া থেকে যেমন কাউকে বিরত রাখার চেষ্টা করা যাবে না, একইভাবে ভোট না দিতে চাইলেও কাউকে বাধা দেওয়া যাবে না।
নির্বাচনী উৎকোচ :উপরোলিস্নখিত ভোটাধিকার প্রয়োগে প্রার্থী কিংবা ভোটার থাকবেন স্বাধীন। ভোটাধিকার যখন কোনো ব্যক্তি অন্যের প্ররোচনায় পড়ে তার কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে প্রয়োগ করতে যান, তখন তা আইনের চোখে অপরাধ এবং উৎকোচ প্রদানকারী ও গ্রহণকারী উভয়েই আইনের চোখে সমানভাবে দোষী। পেনাল কোডের ১৭১(খ) ধারায় উৎকোচের এ বিধানে বলা আছে। সুতরাং, কারো কাছ থেকে উৎকোচ হিসেবে অর্থ নিয়ে যদি কোনো ব্যক্তি প্রার্থী হন কিংবা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন, তাও আইনের চোখে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। একইভাবে উৎকোচের অর্থ নিয়ে ভোট প্রদান করলে কিংবা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকলেও তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। তবে কোনো প্রার্থী যখন নির্বাচনী ইশতেহার কিংবা নির্বাচনী প্রতিশ্রম্নতি প্রদান করে জনগণকে নিজের পক্ষে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে উদ্বুদ্ধ করেন, তখন তাকে উৎকোচ বলা যাবে না।
উৎকোচ প্রদান কিংবা গ্রহণের এ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার জন্য উৎকোচ যে সরাসরি হাতে হাতে আদান-প্রদান হয়ে যেতে হবে, তা নয়। উৎকোচ প্রদান কিংবা গ্রহণের লোভ দেখালে, উৎকোচ দিতে বা নিতে সম্মত হলে তাও উৎকোচ হিসেবে গণ্য হবে এবং অপরাধীদের একই সাজা পেতে হবে। ১৭১(ঙ) ধারা অনুসারে, এভাবে উৎকোচ দেওয়া বা নেওয়ার সাজা এক বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা অর্থদন্ড অথবা দুটোই। তবে উৎকোচ হিসেবে খাদ্য, পানীয়, বিনোদনমূলক ব্যবস্থা করা হলে তার সাজা কেবলই অর্থদন্ড।
নির্বাচনে অনুচিত প্রভাব :প্রার্থী কিংবা ভোটারের অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগে কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করে বা প্রভাব খাটায়, তখন তাকে 'অনুচিত প্রভাব' হিসেবে অভিহিত করা হবে। পেনাল কোডের ১৭১(গ) ধারা অনুসারে প্রার্থী, ভোটার কিংবা প্রার্থী-ভোটারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তির (যেমন প্রার্থী কিংবা ভোটারের নাবালক সন্তান) বা সম্পত্তির যদি কেউ অবৈধ ক্ষতিসাধন করার হুমকি দেন তাহলে তাকে 'অনুচিত প্রভাব' বলা হবে। সুতরাং, ভোট দিতে বা ভোট না দিতে বাধ্য করার জন্য কেউ যদি কোনো ভোটারের সন্তানকে অপহরণ কিংবা মা-বোনকে যৌন হয়রানির হুমকি দেন কিংবা তার ফসলের ক্ষতিসাধন করতে চান, তখন এ ধরনের কাজ অনুচিত প্রভাবের আওতায় পড়বে। আবার কেউ যদি এই ভয় দেখান যে, তার কথামতো ভোটাধিকার প্রয়োগ করা না হলে প্রার্থী, ভোটার কিংবা প্রার্থী-ভোটারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি (যেমন প্রার্থী কিংবা ভোটারের নাবালক সন্তান) বা সম্পত্তি স্বর্গীয় অসন্তুষ্টি কিংবা আধ্যাত্মিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে, সে ক্ষেত্রে এ ধরনের ভীতি প্রদর্শনকেও 'অনুচিত প্রভাব' বলা হবে।
সুতরাং, অমুককে ভোট দিলে বা না দিলে খোদার অভিশাপ পড়বে এ রকমের কথা রটিয়ে দেওয়াও 'অনুচিত প্রভাব' হিসেবে বিবেচিত হবে। ১৭১(চ) ধারা অনুসারে, এ ধরনের অনুচিত প্রভাবের জন্য এক বছরের কারাদন্ড কিংবা আর্থিক দন্ড বা উভয় সাজা পেতে হতে পারে।
ভুয়া বা জাল ভোট প্রদান করা :জীবিত, মৃত কিংবা এমন কোনো ব্যক্তি যে এরই মধ্যে ভোট দিয়ে ফেলেছে তাদের নামে যদি অন্য কোনো ব্যক্তি ভোট প্রদান করেন কিংবা একই ব্যক্তি একাধিকবার ভোট প্রদান করেন, তবে সেই কাজ একটি ফৌজদারি অপরাধ এবং এরজন্য অনুচিত প্রভাবের মতোই শাস্তি পেতে হবে অপরাধীকে। ভুয়া বা জাল ভোট প্রদানে কাউকে নিয়োগ কিংবা প্ররোচিত করলে অথবা এ ধরনের অপরাধ করতে উদ্যত হলেও একই সাজা পেতে হবে।
প্রার্থী সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেওয়া :১৭১(ছ) ধারা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী কোনো প্রার্থীর ব্যক্তিগত চরিত্র বা আচরণ সম্পর্কে নিজে যা বিশ্বাস করে না, এ রকম কোনো তথ্য ভোটারদের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে প্রদান করলে অর্থদন্ডে দন্ডিত হতে পারেন।
নির্বাচনী ব্যয়সংক্রান্ত অপরাধ :এ ছাড়াও ১৭১(জ) ধারা অনুসারে কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাতে গিয়ে নির্বাচনী ব্যয় হিসেবে ওই প্রার্থীর অনুমতি ছাড়া কোনো খরচ করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
সুতরাং, প্রার্থীর পক্ষ থেকে অন্য কাউকে যদি প্রচারণা চালাতে গিয়ে কোনো নির্বাচনী ব্যয় করতে হয়, সে ক্ষেত্রে এ ধরনের খরচের আগে তাকে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী থেকে ক্ষমতা বা অনুমোদন নিয়ে নিতে হবে। আবার নির্বাচনী ব্যয় সম্পর্কে কোনো যথাযথ কর্তৃপক্ষ যদি প্রার্থীর কাছ থেকে হিসাব জানতে চায়, তখন সেই হিসাব প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হলেও আর্থিক জরিমানার সম্মুখীন হতে হবে। ১৭১(ঝ) ধারায় এ বিধান বলা আছে।