সুপ্রিম কোর্টের উলেস্নখযোগ্য রায়ের সালতামামি
২০২৩ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ থেকে বেশকিছু আলোচিত রায়, আদেশ, পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত এসেছে। এছাড়া বিদায়ী বছরে উচ্চ আদালতের মন্তব্যে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বছর শুরু থেকেই বিভিন্ন আদালতে বিচারকদের সঙ্গে খারাপ আচরণের জেরে দেশের বেশ কয়েকটি জেলার আইনজীবী নেতাকে তলব করে কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করেন হাইকোর্ট বিভাগ।
প্রকাশ | ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আইন ও বিচার ডেস্ক
মাকে অভিভাবকের স্বীকৃতি দিয়ে রায়, স্বয়ং বিচারককে এক মাসের সাজা দিয়ে হাইকোর্ট বিরল নজির সৃষ্টি করে। এছাড়াও 'দেশটাকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন' অবসরের আগে এক বিচারপতির এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
র্
যাব হেফাজতে নারী মৃতু্যর ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন, হিন্দু নারীদের ডিভোর্সের অধিকার দিতে রুল, রাষ্ট্রপতি নিয়োগ নিয়ে রিট খারিজ করে রিটকারীকে লাখ টাকা জরিমানা, বিনামূল্যে চিকিৎসা নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা, দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে জাতীয় সংসদকে হাইকোর্টের ১৬ পরামর্শ, কোম্পানি আইন সংশোধন ও যুগোপযোগী করতে হাইকোর্টের রায়, দুই বছরের বেশি সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে রায়, রাজনীতিবিদরা সমাজের রক্ষক; ভক্ষক হতে পারে না, বলে হাইকোর্টের মন্তব্য, ধারাভাষ্য থেকে ওয়াকার ইউনিসের নাম প্রত্যাহারে রুল, পটুয়াখালীর দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ, মুচলেকা দিয়ে শিশু বক্তার জামিন, ইভ্যালির প্রকৃত পাওনাদাররা অর্থ ফেরত পাবেন বলে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ, বিচারপতিকে নিয়ে কটূক্তির কারণে বিএনপি নেতা হাবিবকে ৫ মাসের সাজা, বিএনপির শীর্ষ ৭ আইনজীবীকে তলব, আদালত অবমাননার কারণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সচিব ও আইজি প্রিজন্সকে তলব, বিদায়ী বছরের উচ্চ অন্যতম আলোচিত ঘটনা।
ফরম পূরণে অভিভাবক হিসেবে লেখা যাবে মায়ের নাম
শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ফরম পূরণের ক্ষেত্রে অভিভাবক কলামে বাবা অথবা মা অথবা আইনগত অভিভাবকের নাম সংযোজনের নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। এ রায়ের ফলে তিনজনের কেউ একজনের নাম দিয়ে ফরম পূরণ করা যাবে। এখন এ রায়ের আলোকে সব ফর্ম সংশোধনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সব শিক্ষা বোর্ডকে নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।
২০০৭ সালের ২৮ মার্চ দৈনিক প্রথম আলোয় 'বাবার পরিচয় নেই, বন্ধ হলো মেয়ের লেখাপড়া' শীর্ষক শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদন যুক্ত করে রেজিস্ট্রেশন কার্ড না দেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে রিট করে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও নারীপক্ষ। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০০৯ সালের ১ আগস্ট রুল জারি করেন হাইকোর্ট। সেই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২৪ জানুয়ারি রায় দেন হাইকোর্ট।
'দেশটাকে তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন'
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিনের দন্ডের বিরুদ্ধে করা আপিলের গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ক শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই মন্তব্য করেন। এ মামলায় আবেদনকারীদের আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলীর শুনানির আগে রাষ্ট্রপক্ষ কথা বলতে চাইলে আদালত বলেন, তাদের (আপিলকারীদের) আইনজীবীদের আগে বলতে দিন। আপনি (রাষ্ট্রপক্ষ) আগেই লাফ দিয়ে উঠছেন কেন? দেশটাকে তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, ভারাক্রান্ত, মর্মাহত এই কথা শোনার পরে। একজন বিচারক এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন কিনা? তিনি সংবিধান সংরক্ষণের জন্য শপথ নেন। তিনি এ ধরনের অসাংবিধানিক কথা বলা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমি মনে করি, তিনি তার শপথ ভঙ্গ করেছেন।
নওগাঁওর্ যাব হেফাজতে নারীর
মৃতু্য :তদন্ত কমিটি গঠন
নওগাঁয়র্ যাব হেফাজতে জেসমিন (৪৫) নামে এক নারীর মৃতু্যর পুরো ঘটনার তদন্ত করতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এক আইনজীবীর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহম্মদ মাহবুব-উল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। পরে কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করে।
গত ২২ মার্চ নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় থেকে সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয়। এরপর শুক্রবার (২৪ মার্চ) সকাল ৯টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই নারীর মৃতু্য হয়। সুলতানা জেসমিন নওগাঁ সদর উপজেলার চন্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সহকারী পদে চাকরি করতেন।
র্
যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের র্(যাব) ভাষ্য, সুলতানা জেসমিনের নামে প্রতারণার অভিযোগ ছিল। সে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে আটক করা হয়েছিল। আটকের পরপরই সুলতানা জেসমিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার পর চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।
সেখানে তার শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ মার্চ শুক্রবার স্ট্রোক করে মৃতু্যবরণ করেন তিনি। আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২৫ মার্চ দুপুরে স্বজনদের কাছে তার মরদেহ হস্তান্তর করা হয়।
বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা
পাওয়া মৌলিক অধিকার
'প্রত্যক ব্যক্তির বিনামূল্যে সব ধরনের চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া তার সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার এবং এ অধিকার তার বেঁচে থাকার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত'।
১৯৯১ সালে এবং ২০০৯ সালে ভেজাল প্যারাসিটামল সেবনে মারা যাওয়া ১০৪ শিশু নিয়ে করা রিটের চূড়ান্ত রায়ে এ মৌলিক অধিকারের কথা উলেস্নখ করেন বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ে ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধে একটি স্বাধীন জাতীয় ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
একইসঙ্গে ভেজাল প্যারাসিটামল সেবনে মারা যাওয়া ১০৪ শিশুর প্রত্যেক পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঔষধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ ওই ক্ষতিপূরণের টাকা সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তি, ওষুধ কোম্পানি থেকে আদায় করতে পারবেন।
বিচারক সোহেল রানার সাজা
২০১৭ সালের কুমিলস্নার কোতোয়ালি মডেল থানায় টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের এক মামলার কার্যক্রমের বৈধতা নিয়ে আসামিরা হাইকোর্টে একটি আবেদন করেন। ওই আবেদনের শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর হাইকোর্ট রুল জারি করে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত করেন। এ স্থগিতাদেশ থাকা সত্ত্বেও কুমিলস্নার তৎকালীন চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা গত ১০ এপ্রিল মামলায় অভিযোগ গঠন করেন।
উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে বিচার কাজ পরিচালনার বিষয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন আসামিরা। বিচারককে তলব করে জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে উচ্চ আদালত অবমাননার রুল দেন। শুনানি শেষে আদেশে ৩০ দিনের বিনাশ্রম কারাদন্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়। পরে তাকে জামিন দেওয়া হয়। আর আপিল বিভাগে আবেদনের পর তার দন্ড ও জরিমানা স্থগিত করা হয়। পরে তিনি আপিল করেন। বর্তমানে মামলাটির আপিলের রায়ের জন্য ২৩ জানুয়ারি দিন নির্ধারিত আছে।
দন্ড বাতিল না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে
অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই
দুর্নীতির মামলায় দুই বছরের বেশি দন্ডিতদের দন্ড বাতিল না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় দন্ড স্থগিতের সুযোগ নেই বলেও রায় দেন উচ্চ আদালত।
দুর্নীতির মামলায় দন্ডিত ৫ বিএনপি নেতার আবেদন খারিজ করে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় দেন বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে রিট খারিজ
গত ১৩ ফেব্রম্নয়ারি রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিনকে নির্বাচিত ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন প্রজ্ঞাপন জারি করে। এ প্রজ্ঞাপনের কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে ৭ মার্চ একটি রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম এ আজিজ খান।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিনকে নির্বাচিত ঘোষণা করা সংক্রান্ত ইসির প্রজ্ঞাপন নিয়ে আবদুল মোমেন চৌধুরী, কে এম জাবিরসহ সুপ্রিম কোর্টের ছয় আইনজীবী ১২ মার্চ আরেকটি রিট করেন। পৃথক দুটি রিটের ওপর শুনানি নিয়ে ১৫ মার্চ তা সরাসরি খারিজ করেন বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও মো. ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
এরপর এম এ আজিজ খান আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন। যেটি ১৮ মে খারিজ হয়ে যায়। রাষ্ট্রের সময় নষ্ট করা, আদালতের সময় নষ্ট করাসহ বিভিন্ন কারণে মামলার খরচ হিসেবে এক লাখ টাকা রিটকারীকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে বলেছেন আপিল বিভাগ। পরে এ আইনজীবী রিভিউ করেন। সেটিও খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
বিএনপির ৭ আইনজীবীকে তলব
আপিল বিভাগের দুই বিচারপতির বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সংবাদ সম্মেলন ও মিছিল-সমাবেশ করায় তার ব্যাখ্যা দিতে বিএনপির সাত আইনজীবী তলব করেন আপিল বিভাগ। আগামী ১৫ জানুয়ারি তাদের আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন। সাত আইনজীবী হলেন- জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুন্নি, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সুপ্রিম কোর্ট শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার ভূঁইয়া, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সহসম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান খান ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সুপ্রিম কোর্ট শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল।
অবসরের তিন বছর শেষ হওয়ার আগে নির্বাচন নয়
সরকারি চাকরি থেকে অবসরের তিন বছর অতিক্রম করার আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) এমন বিধান বৈধ বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে জারি করা রুল খারিজ করে দেন বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
শো'কজ ছাড়া কর্মী অপসারণ
করতে পারবে দুদক
কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্মচারীকে অপসারণ করা সংক্রান্ত ৫৪(২) বিধি বাতিলের বিরুদ্ধে আপিল মঞ্জুর করেছেন আপিল বিভাগ। ফলে শো'কজ ছাড়াই কর্মী অপসারণে দুদকের বিধি বহাল থাকল। আর এ কারণেই চাকরি ফেরত পাবেন না চাকরিচু্যত আহসান আলী ও শরীফ উদ্দিন। ১৬ মার্চ ততকালীন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বিভাগ রায় দেন।