নবান্নের সেকাল-একাল
নবান্ন শব্দের অর্থ নতুন অন্ন বা নব অন্ন। অগ্রহায়ণ মাসে বছরের প্রধান শস্য আমন ধান সংগ্রহ করে সেই ধানের নতুন চাল দিয়ে তৈরি প্রথম ভাত রান্না উপলক্ষে যে উৎসব করা হয় তাকেই নবান্ন উৎসব বলা হয়।
প্রকাশ | ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
খোন্দকার শাহিদুল হক
ঋতু বা মৌসুম বছরের একটি খন্ডকাল যা নির্দিষ্ট সূত্রের ভিত্তিতে স্থির করা হয়েছে। সেই সূত্রে বাংলাদেশ বা এতদাঞ্চলে বছরের ১২ মাসে ৬টি ঋতু বিদ্যমান। অর্থাৎ প্রতি দুই মাস অন্তর ১টি ঋতুর আগমন হয়। সাধারণত পৃথিবীর বার্ষিক গতির কারণে ঋতু পরিবর্তিত হয় বা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এই ঋতুসমূহ গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত নামে পরিচিত। মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য ডিসেম্বর অর্থাৎ কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুই মাস হেমন্ত ঋতু হিসেবে পরিচিত। এটি ষড়ঋতুর চতুর্থ ঋতু। আর ঋতুবৈচিত্র্যের কারণে হেমন্ত আসে শীতের আগেই। হেমন্তের শুরতে কার্তিক মাস এলে মাঠের এবং ধান ক্ষেতের পানি একেবারে শুকিয়ে যায়। মাঠে তখন সোনালি ধানের ঢেউ খেলতে থাকে। ধানে সোনালি রং চড়লেই কৃষকরা তখন ধান কেটে বাড়ি নেওয়া শুরু করে। তখন চারদিকে ধান কাটার ধুম পড়ে যায়। গ্রামের প্রতি বাড়িতে বাড়িতে ধান তোলা শুরু হয়। আগের দিনে কৃষাণ-কৃষাণীরা মাঠের ধান উঠানে বা আঙিনার একপাশে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পালা দিয়ে রাখত। সেই পালা বা মুরি থেকে উঠানের মাঝে বড় একটি কাঠ বা শক্ত কিছু পেতে সেই কাঠের মধ্যে ধান পিটিয়ে পিটিয়ে ধান সংগ্রহ করত। আবার সারা উঠানের মধ্যে ধান গাছ ছড়িয়ে, ছিটিয়ে দিয়ে অর্থাৎ মাড়াই দিয়ে ধান গাছ থেকে ধান পৃথক করে নিত। বর্তমানে যন্ত্রের সাহায্যে ধান মাড়াই করা হয়। সবকিছু যান্ত্রিক হলেও এ ঋতুতে কৃষকের মধ্যে ফসল কাটার ব্যস্ততা দেখা দেয়। শুরু হয় ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব।
মূলত নবান্ন হলো বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী আমন ধানের চাল থেকে তৈরি অন্ন বা ভাত-পিঠার উৎসব। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্নতম। নবান্ন শব্দের অর্থ নতুন অন্ন বা নব অন্ন। অগ্রহায়ণ মাসে বছরের প্রধান শস্য আমন ধান সংগ্রহ করে সেই ধানের নতুন চাল দিয়ে তৈরি প্রথম ভাত রান্না উপলক্ষে যে উৎসব করা হয় তাকেই নবান্ন উৎসব বলা হয়। নবান্ন নিয়ে আসে সবার মনে খুশির বার্তা। আর সেই খুশির কারণ হলো, এক সময় কার্তিকে গ্রামঞ্চলে দুর্ভিক্ষ নামত। যার নাম ছিল মঙ্গা কার্তিক। তাই কবে কার্তিক পেরিয়ে অগ্রহায়ণ আসবে সেই প্রতীক্ষায় সময় কাটাতো প্রান্তিক মানুষ। মুখে নতুন অন্ন জোগানোর অতি আগ্রহ নিয়ে পার করতে হতো এই সময়টুকু। পরিশেষে কার্তিকের শেষ দিকে ও অগ্রহায়ণের শুরুতেই শুরু হতো আমন ধান কাটা। এ সময় নতুন ধান ঘরে উঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকে কৃষাণ কৃষাণীরা। আর ধান ঘরে উঠলে পিঠে পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। পাড়ায় পাড়ায় চলে নবান্ন উৎসব। নবান্ন উৎসবে নতুন চালের ভাতের পাশাপাশি নানা রকম পিঠা পায়েসের ব্যবস্থাও করা হয়। নবান্ন উৎসবে আয়োজিত খাদ্যসামগ্রী আত্মীয়-স্বজনকে পরিবেশন করার পর গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ নতুন গুড়সহ নতুন অন্ন গ্রহণ করেন। নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী বাড়ির পোষা প্রাণীসহ কাকপক্ষীকেও নিবেদন করা নবান্নের একটি বিশেষ লৌকিক প্রথা। এসব আনুষ্ঠানিকতার ফলে গ্রাম বাংলায় নতুন এক আবহের সৃষ্টি হয়। নবান্ন উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, আর সংস্কৃতির নানা দিক। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি ধর্ম বর্ণ উপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে। একে অন্যের মধ্যে তৈরি হয় এক সামাজিক বন্ধনের সম্পর্ক।
বাংলাদেশে আবহমানকাল ধরে বহমান এই নবান্ন উৎসব অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপনের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য ১৯৯৮ সাল থেকে থেকে রাজধানী ঢাকা শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব উদযাপন শুরু হয়। জাতীয় নবান্নোৎসব উদযাপন পর্ষদ প্রতিবছর পহেলা অগ্রহায়ণ তারিখে এই নবান্ন উৎসব উদযাপন করে। বিভিন্ন সংগঠন অন্তত ৩ দিনব্যাপী আয়োজিত নবান্ন উৎসবে পিঠা মেলার আয়োজন করে আসছে। এই মেলায় গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী পিঠা পায়েস যুক্ত হয়। সেই সঙ্গে উৎসব প্রাঙ্গণে চিত্ত বিনোদনের জন্য লোকগীতি, লালনগীতি, বাউল গান, সাপ খেলা, বানর খেলা, লাঠিখেলা, নাগরদোলা, পুতুলনাচ, পথনাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা থাকে। এই নবান্ন উৎসবের সমাপনী দিনে শিল্পীদের পুরস্কার প্রদান করা হয়। তাই বলা যায় যে, বাংলার একটি অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব ছিল এই নবান্ন উৎসব।
ছিল বলছি এই জন্য যে, অতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা বাঙালি সমাজের সেই নবান্নের উৎসব আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। সামাজিক পরিবর্তনের ফলে গ্রাম বাংলা আস্তে আস্তে নগরায়ণে পরিবর্তন হচ্ছে। গ্রামের মা বোনেরা আজ আর ঢেঁকিতে ধান ভানে না। আগে কাকডাকা ভোরে উঠে গ্রামের প্রতি বাড়ির মহিলা ধান ভানত এবং বিভিন্ন রকমের গীত গাইত। সেই ঢেঁকি ছাঁটা চালের ভাত গ্রাম-শহরের মানুষ খেত। মেশিনে ধান, গম, ভাঙার প্রচলন হওয়ার পর গ্রামের মানুষের অর্ধেকের বেশি পরিশ্রম কমে গেছে। বর্তমান প্রজন্ম ফাস্ট ফুডে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে তারা আর নবান্নের পিঠা-পায়েস ইত্যাদি তেমন পছন্দ করে না। এমনকি গ্রামে যেতেও পছন্দ করে না। গ্রামের বিভিন্ন উৎসবসহ নানা কাজে তাদের অনীহা দেখা যায়। গ্রাম বাংলায় শহরাঞ্চলের সংস্কৃতি ঢুকে নবান্নের উৎসবকে ম্স্নান করে দিচ্ছে। ফলে এভাবে চলতে থাকলে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিগুলো বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তখন নবান্ন কথাটি সীমাবদ্ধ থাকবে শুধুই বই-পুস্তকে। তাই আমাদের বাঙালির ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তার বন্ধনের আদি সূত্র এই নবান্নকে ধরে রাখার জন্য এখনই নিতে হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।