আমি সভ্যতার কথা বলছি

প্রকাশ | ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সীমান্ত চক্রবর্তী
আরডিআরএস'র উদ্দেশে রওনা দিলাম। সময় আনুমানিক সাড়ে ১০টা হবে। যাওয়ার কথা ছিল সকাল ৯টায়। কিন্তু বাঙালিদের সময় বলে কথা! এক-দেড় ঘণ্টা দেরি না হলে কি হয়। ইয়ুথ হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের আয়োজনে একটি সামাজিক সম্প্রীতি অনুষ্ঠান। আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে, সেখানেই যাচ্ছিা। খাদেমের একটু শরীর খারাপ, তাই ওর জন্য ওষুধ নিয়ে আসল আমাদের সহযোদ্ধা মুয়াজ। অটোতে করে যাচ্ছি। আমাদের আপু সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিল কেন সবার দেরি হয়েছে? নানান কথা বলল বিভিন্ন রকম অজুহাত। সবাই নানা বাধা পেরিয়ে আরডিআরএসএ এলাম। প্রতিষ্ঠানটির পরিবেশ অনেক সুন্দর, মনোমুগ্ধকর ও চমৎকার। আমাদের সঙ্গে একজন বড় আপু ছিলেন। তিনি বললেন, এখানকার পরিবেশ অনেক ভালো। প্রথমেই আমাদের আপ্যায়ন করল মিষ্টি দিয়ে। তাদের আপ্যায়নে সবাই খুশি। অনুষ্ঠানে আমরা সাতজন এসেছি, সামাজিক সম্প্রীতি অনুষ্ঠান। অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এসেছেন। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর ঘোষণা করা হলো, কে কে কথা বলতে চাও, তোমাদের মতামত প্রকাশ করতে চাও? প্রথমেই হাত তুলে সম্মতি জানালেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় আপু। তিনি সামাজিক সম্প্রীতির বিষয়ে অনেক কিছু বললেন। তিনি হরিজনদের সম্পর্কে কিছু বললেন। হরিজনদের অবহেলার কথা তুলে ধরে সবাইকে মানবিক হওয়ার আহ্বান জানালেন। সবাই করজোরে হাততালি দিলেন। এরপর আমিও কিছু বললাম। সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা, আমরা সামাজিক দায়বদ্ধতা এড়িয়ে চলি। শিক্ষিত জাতি দেশের মেরুদন্ড। কিন্তু আমরা এর ব্যতিক্রম দেখতে পাই। যারা অশিক্ষিত, শ্রমিক, কৃষক তারাই বিদেশে যাচ্ছে এবং বিদেশ থেকে দেশে টাকা পাঠাচ্ছে আর দেশের অর্থনীতি বৃদ্ধিতে সাহায্য করছে। দেশজ আয়ের প্রধান একটি উৎস হচ্ছে তাদের রেমিট্যান্সের টাকা। তারাই দেশকে ঋণমুক্ত করছে। তারাই আসল নাগরিক। অথচ যাদের জন্য সরকার লাখ লাখ টাকা ব্যয় করছে, তারাই দেশকে কিছুই দিচ্ছে না। সরকার তাদের উচ্চ শিক্ষার জন্য স্কলারশিপ দিচ্ছে। স্কলারশিপের প্রধান অঙ্গীকার হলো 'তুমি বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ কর এবং দেশকে উচ্চশিক্ষিত কর।' অথচ তারা বিদেশে এই অঙ্গীকার নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেই দায়বদ্ধতাকে ভুলে যাচ্ছে। তারা শিকড়ের কথা ভুলে যাচ্ছে। শিক্ষিত হয়েও তার অশিক্ষিত নয় কি? একবার ভাবুন, তারা বিদেশে গিয়ে কেবল নিজের উন্নতি করছে। কিন্তু তারা যদি দেশে ফিরে আসত, তাহলে সবার উন্নতি হতো। এমন একটা সময় আসত যখন বিদেশে যেতেই হতো না। সময় সংক্ষিপ্ত হওয়ায় বেশি কিছু বলতে পারলাম না। অনেকেই আমার প্রশংসা করল। অন্যের প্রশংসা জীবনের অনুপ্রেরণা হয়ে জীবনকে গতি প্রদান করে। অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রীতি বিতর্কের পুরস্কার নেওয়ার পালা। এর মধ্যে একজন উঠে দাঁড়াল, 'আমি কিছু বলতে চাই'। সে বলা শুরু করল, আমি অশিক্ষিত। একটা সময় ছিল স্বাভাবিক শিশুদের মতো আমার মনেতেও লেখাপড়ার ইচ্ছা ছিল। আমি দুই-এক বছর স্কুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন বড় হতে থাকি, ঠিক ধীরে ধীরে আমার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। যখন ছেলেদের সারিতে বসতাম তখন আমাকে বলত, তোমার চুল লম্বা কেন! তুমি তো মেয়ে। মেয়েদের সারিতে বস। আবার যখন মেয়েদের সারিতে বসতাম, তখন শিক্ষকরা বলত তুমি ছেলেদের সারিতে বস। এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম ধাক্কা। নেই সম্মান, শুধুই লাঞ্ছনা। সবাই আমাকে নিয়ে মজা করত। ছেলেদের টয়লেট আছে, মেয়েদের টয়লেট আছে। কিন্তু আমাদের টয়লেট কোথায়? এর উত্তর আজও খুঁজে বেড়াই আমি। এরপরও আমি গিয়েছিলাম বিদ্যালয়ে, কিন্তু সমাজ আমাকে সামাজিক হতে দেয়নি। এর কয়েক বছর পর শুরু হলো হাতে তালি দিয়ে রাস্তায় টাকা তোলা। টাকা তোলার সময় অনেকেই গালি দিত আমাদের। অনেকেই বলত 'কাজ করে খেতে পারিস না।' তখন নিজেকেই প্রশ্ন করি, এই সমাজ কি আমাদের কাজ করতে দিয়েছে? এই সমাজ কি আমাদের সামাজিক হতে দিয়েছে। আর যে সামাজিক নয়, সে কীভাবে কাজ করবে? প্রশ্নগুলোর উত্তরে হয়তো বা একজন বয়স্ক মহিলা আমার দিকে তাকিয়েছে। আমাদের কে সেলাই মেশিন কিনে দেয়। আমরা সেলাই মেশিনের কাজও শিখেছিলাম। আমরা আনন্দিত ছিলাম। কিন্তু ওই যে বললাম সমাজ আমাদের অসামাজিক করে রেখেছে। তাই সবাই কাপড় নিতে মহিলার কাছে যায়, বৃদ্ধ ব্যক্তির কাছে যায়, কিন্তু আমাদের কাছে আসে না। আমি যদি তার জায়গায় হতাম, তাহলে লিখতাম.... সভ্যতার শিক্ষক/কেড়ে নেয় শিক্ষা;/খালি হাতে তালি বেজে/ নিতে হয় ভিক্ষা।/অস্ত্র দিয়েছে প্রভু/মরুভূমির প্রান্তে/শত্রম্ন খুঁজি তবু/ রোদ ভরা ক্লান্তে। যখন ডাক্তারকে দেখাতে যাই তখন না তো পুরুষের ঘরে টিক দিতে পারি আর না তো মহিলার ঘরে। যার কারণে হয়তো বা ডাক্তারকেও দেখানো উচিত নয় আমাদের। এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা সানির কথা শুনছি। কথা শেষ হওয়ার পর পাশে থেকে দিদি বলল, একেই বলে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া। আমরা দেখতে পারি, পরীক্ষায় নব্বই শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু বাস্তবে কি সত্যিই হয় তা? বিআরইউডিএফ'র সুযোগে এতদূর আসার পরও বিতর্কের পুরস্কার নেওয়ার মতো আনন্দ আর আমার মধ্যে নেই। সানির বিষয়টি আমার মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। যখন ফিরে আসি ছাত্রাবাসে, তখনো বিষয়টি আমাকে ভাবতে বাধ্য করায়। রাতে যখন ঘুমোতে যাই তখন ঘুমতে পারি না। স্বপ্ন যখন বাস্তবতার কাছে হার মানে, তখন রাত্রিকালে ঘুম ভাঙে। আমি তৃতীয় লিঙ্গের কথা বলছি। আমি আমাদের কথা বলছি। আমি সভ্যতার কথা বলছি। সদস্য ফ্রেন্ডস ফোরাম বেরোবি, রংপুর।