নবান্নের ঋতু হেমন্ত

প্রকাশ | ২৬ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

মো. আশরাফুল আলম
বাংলা কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুই মাস নিয়ে হেমন্তকাল। প্রতিটি ঋতুর ন্যায় হেমন্তেরও আছে নিজস্ব বিচিত্রতা ও সৌন্দর্য। এই হেমন্ত প্রতিবারের ন্যায় এবারও বাংলায় এসেছে চিরচেনা রূপে। যে রূপে মুগ্ধ হয়ে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ, ভোরের কাক হয়ে কিংবা শঙ্খচিল/শালিকের বেশে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে আবার ফিরে আসার আকুতি ব্যক্ত করেছেন। হেমন্ত বহুরূপী, প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ একটি ঋতু। নাতিশীতোষ্ণ এ ঋতু শরতের সাদা মেঘ আর মনকাড়া কাশবন পার হয়ে শীতের আগাম বার্তা নিয়ে বাংলায় আগমন করে। কখনো মেঘ, কখনো কুয়াশা, আবার কখনো মেঘমুক্ত নীল আকাশ হেমন্তের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ সময় দিগন্ত বিস্তৃৃত পাকা ধানের মাঠ দেখে কৃষক মন ব্যাকুল হয়। নতুন ফসল ঘরে তুলতে কৃষাণ-কৃষাণিরা জমিতে ব্যস্ত সময় পার করেন। এ সময় গ্রাম বাংলা মেতে ওঠে ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসবে। গ্রামে-গঞ্জে বসে মেলা, বাড়ি বাড়ি থেকে আসে ঢেঁকিতে ধান বানার শব্দ তবে এখন ঢেঁকি আর নেই বললেই চলে, ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েসের আয়োজনে মুখরিত হয়ে ওঠে আমাদের দেশ। হেমন্তে পুকুর-বিল-ঝিল-হাওড়-বাওড় শুকাতে শুরু করে। এ সময় গ্রামের জেলে, উঠতি বয়সি ছেলেরা মাছ ধরার উৎসবে মেতে ওঠে। গৃহিনীর রান্নাঘর থেকে তাজা মাছ ভাজার গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কৃষাণ-কৃষাণির এমন আনন্দ আয়োজনে প্রকৃতি যেন নিজ উদ্যোগে সাজে। এ সময় প্রকৃতিতে ফোটে শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মলিস্নকা, দেব কাঞ্চন, হিমঝুরিসহ আরও অনেক রকম ফুল। হেমন্তেও শেষের দিকে গাছিরা খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ শুরু করে। তারা ভোর হওয়ার আগেই খেজুরের রস সংগ্রহ করে হাটে বিক্রি করতে নিয়ে যায়। এই হেমন্তেই আমাদের দেশে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে অতিথি পাখিদের আগমন শুরু হয়। আবার শীত শেষে আবার ফিরে যায় তারা। তবে গ্রাম বাংলার জন্য হেমন্ত অপূর্ব হলেও শহুরে জীবনে এর তেমন প্রভাব দেখা যায় না। এ ঋতুতে অসময় অতিবৃষ্টি হওয়া ও উজান থেকে আসা ঢলের পানির প্রভাবে অনেক সময় দেশে বন্যা হতে দেখা যায়। আবার এসব কারণে এ ঋতুর বিশাল অংশ জুড়েই শাকসব্জি তরিতরকারির উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেয়। এজন্য শহরের বাজারে তরিতরকারির দাম বৃদ্ধি পায়, যা শহরের মানুষদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। তবে হেমন্তের শেষ দিকে শীতের আগাম শাকসব্জি এসে এ ঘাটতিটা দূর করে। ক্ষণস্থায়ী হেমন্ত খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে বহুরূপে উপস্থাপন করে। হেমন্ত ম্স্নান, অস্পষ্ট, ধূসর তাকে অনুভব করা গেলেও দেখা যায় না। তাই তো হেমন্তকে বলা হয় অনুভবের ঋতু। এই হেমন্ত কবি মনকেও মুগ্ধ করে। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হেমন্তের রূপে মুগ্ধ হয়ে লেখেন, 'হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে,/হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে।/ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো 'দীপালিকায় জ্বালাও আলো,/জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।' আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চোখেও হেমন্ত ধরা দিয়েছে বিশেষ রূপে। তাই প্রেমের কবি নজরুল হেমন্তকে নিয়ে লেখেন, 'ঋতুর খাঞ্জা ভরিয়া এলো কি ধরণীর সওগাত?/নবীন ধানের অঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হলো মাৎ।/'গিন্নি পাগল' চালের ফিরনি/ তশতরি ভরে নবীনা গিন্নি/হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত।/শিরনি রাঁধেন বড় বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত।'