শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

অসুর বিনাশিনী দেবী দুর্গা

জ্যোতিষ সমাদ্দার বাবু
  ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
অসুর বিনাশিনী দেবী দুর্গা

দুর্গা অর্থাৎ 'যিনি দুর্গতি বা সংকট থেকে রক্ষা করেন'; সনাতন ধর্ম্মীয় সনাতনীদের শরৎকালের বড় উৎসব শারদীয় উৎসব। শারদীয় উৎসব মানেই সর্বজনীন দুর্গাপূজা। মানুষে মানুষে হিংসা বিদ্বেষ ভুলে এক ছাতার নিচে এসে মাতৃরূপে দেবী দুর্গার আরধনা করে। মাতৃরূপে, পিতৃরূপে, শক্তিরূপে, শান্তিরূপে, বিদ্যারূপে আবির্ভূত এক মহাশক্তি। দুর্গা হলো সম্মিলিত দেবশক্তির প্রতীক। অসুর অর্থাৎ অপশক্তি বিনাশে দেবতারা তাদের সম্মিলিত শক্তিতে সৃষ্টি করেছিলেন মহাশক্তি মহামায়ার। দেবী দুর্গা অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বিনাশ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন, তাই তিনি সত্য, শুভ ও ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রামকারীদের জন্য আজও আদর্শ ও অনুপ্রেরণা দানকারী। দুর্গা অর্থই হলো যিনি সম্প্রীতি রক্ষা করে দুর্গতি নাশ করেন। এ ক্ষেত্রে স্বামী বিবেকানন্দও বলেছেন পুতুল পূজা করে না হিন্দু/কাঁঠ মাটি দিয়ে গড়া/মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরে/হয়ে যায় আত্মহারা। শ্রীশ্রী দুর্গাপূজার মূল মন্ত্র হচ্ছে : 'যা দেবী সর্বভুতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা/নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নম:, যা দেবী সর্বভুতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা/নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নম:।'

মুনিঋষিরা মানুষের মধ্যকার সুরশক্তির ও অসুরশক্তির দ্বন্দ্বের কথা এবং পরিণামে যে অসুরশক্তির বিনাশ ও সুরশক্তির জয় হয় সে কথা ধর্মগ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। সব দেবতার তেজরাশির সমন্বিত শক্তিরূপই মহাশক্তি হলো মা দেবী দুর্গা।

শরতের চতুর্দশী তিথির পরে অমাবস্যাতে মহালয়ার আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার মর্তে আগমন ঘটে। সেই থেকেই দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা। শিশির ভেজা ঘাসের ওপর শিউলি ফুলের চাদর এবং দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের ওপর রাশি রাশি কাশফুলের মালা যেন উৎসবপ্রিয় বাঙালিদের জন্য মর্তের স্বর্গ। দুর্গাপূজাতে উন্মাদনা ঘিরে থাকে পাঁচটি দিন। পূজো শুরুর আগেই গরিব ধনী সবাই যেনো পূজোর আনন্দেই থাকে। যে যার সাধ্যমতো নতুন পোশাক নতুন জুতা কিনতে ভিড় জমায় মার্কেটে। পূজো শুধুমাত্র প্যান্ডেলেই সীমাবদ্ধ থাকে না। পাড়ায়-পাড়ায়, ক্লাবে-ক্লাবে ধুম পড়ে যায় আগমনীর বার্তায়। এমনকি আত্মীয়স্বজনদের দেয়া উপহার, তাদের উপস্থিতিও যেন পূজোতে বাড়তি আনন্দ যোগ করে।

যুগের পর যুগ দেবী দুর্গা এভাবে পূজিত হয়ে আসছেন। কখনো ঘটে, পটে আবার নিরাকার রূপে। আবার কখনো মৃন্ময়ী মূর্তির সাকার রূপে। এই মৃন্ময়ী রূপের মাঝে মা চিন্ময়ী হয়ে আছেন। অনাদিকাল ধরে ওই চিন্ময়ী রূপের মধ্যে মায়ের মৃন্ময়ী রূপের প্রকাশ পায়। ওই মৃন্ময়ী রূপ দর্শনের জন্য সাধক, ভক্তগণ চিরকাল ব্যাকুল হয়ে থাকে। ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র রাক্ষসরূপী অসুর মহিরাবণকে ধ্বংসের জন্য মায়ের অকাল বোধন করেন এবং দেবীর উপাসনা করে শক্তি লাভ করে অসুরশক্তির নাশ করেন। রামচন্দ্রের সেই অকালবোধন হয়েছিল শরৎকালে। তাই শরৎকালের দুর্গাপূজাকে শারদীয় পূজা বা শারদীয় উৎসব হিসেবে আবহমানকাল ধরে বাঙালি সনাতন ধর্মালম্বীদের ঘরে ঘরে উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

শরৎকালে অর্থাৎ দক্ষিণায়নে সব দেব-দেবীর মতো দেবীদুর্গা বিষ্ণুমায়া নিদ্রিত থাকেন। শারদীয় দুর্গাপূজায় বোধন হচ্ছে নিদ্রিত দেবীকে জাগ্রত করা। শরৎকালে অকাল বোধনের মাধ্যমে দেবীকে জাগ্রত করে তাই দুর্গার অপর নাম হলো শারদীয়া। আবার শরৎকালে এই দুর্গাপূজা হয় বলে একে শারদীয় দুর্গাপূজা বলা হয়।

শরৎকালে এ ত্রিনয়নী মহাদেবী দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালনে আবির্ভূত হন। এ পূজার মূর্তি কল্পনায় ফুটে ওঠে শৌর্য-বীর্যে (কার্তিক), জ্ঞানভক্তিতে (সরস্বতী), সিদ্ধিতে (গণেশ), সম্পদে (লক্ষ্ণী), মানবজীবনের ইহকালের বস্তুলাভ এবং অন্তিমকালে মাতৃক্রোড়ে চির আশ্রয়। আর মায়ের পদতলে মহিষাসুর অশুভ এবং অহঙ্কারের প্রতীক, যা জগতের অমঙ্গলের হেতু। তাকে আবার শাসন করছেন স্বয়ং দেবী, যিনি কল্যাণময়ী বরাভয়দায়িনী হিসেবে জগতের কল্যাণ করে আসছেন।

হিন্দু পুরাণের মতো অনুসারে, শিবের তেজে দেবীর মুখ, যমের তেজে কেশ, বিষ্ণুর তেজে বাহুসমূহ, চন্দ্র তেজে স্তনদ্বয়, ইন্দ্রের তেজে মধ্যভাগ, বরুণের তেজে জংঘা ও ঊরু, পৃথিবীর তেজে নিতম্ব, ব্রহ্মার তেজে পদযুগল। মহাদেব দিলেন শূল, কৃষ্ণ দিলেন চক্র, শঙ্খ দিলেন বরুণ, অগ্নি দিলেন শক্তি। এই হল বিপদনাশিনী দেবীমাতা দুর্গা। দুর্গতি হতে ত্রাণ করেন বলেই দেবীর নাম হয়েছে দুর্গা। পূজোর শেষে বিজয়া দশমীতে পাড়া-প্রতিবেশীদের জন্য এক মিলনতীর্থ। আগেকার দিনে সেখানে আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা অন্তরঙ্গতায় এক মিলন উৎসবে মেতে উঠত, যা আজকালকার দিনে তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি আছে সেখানেই দুর্গা পূজো আছে, আনন্দ আছে, উৎসবের উন্মাদনা আছে। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে এই পূজো যেন সবাইকে একই সূত্রে বেঁধে রাখে। এ দিনগুলোতে সারা বছরের শত ব্যস্ততাও যেন নিমেষেই গায়েব হয়ে যায়। দশমীর সিঁদুর খেলার পর প্রতিমার চোখেও যেন বিষাদ নেমে আসে। সবারই আবার যার যার কর্মস্থলে ফেরার পালা শুরু হয়ে যায়, আবার একটি বছরের অপেক্ষায় থাকে সবাই। এই অপেক্ষাই যেন অন্য এক আনন্দ সারা বছরজুড়ে। এ মহামিলনের সময় আশা ও বিশ্বাস সব আসুরিক শক্তির বিনাশ হোক। মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা জাগ্রত হোক, জাতিতে জাতিতে হিংসা-বিদ্ধেষ ভুলে একই রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হোক। পৃথিবীর সব অস্ত্র ধ্বংস হোক, মানুষের হৃদয় জাগ্রত হোক। সারা পৃথিবীতে শান্তি বিরাজ করুক। জয়তু দেবী দুর্গা... জয় হোক মনুষ্যত্বের।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে