বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে করণীয়

খোন্দকার শাহিদুল হক
  ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
বিশ্ব শিক্ষক দিবসে করণীয়

আজ ৫ অক্টোবর ২০২৪ বিশ্ব শিক্ষক দিবস, শিক্ষকদের সম্মানার্থে পালিত বিশেষ একটি দিবস। ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আবার ভিন্ন ভিন্ন দিনেও উদযাপিত হয়। শিক্ষকদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য অবদানের জন্য এ সম্মাননা দেওয়া হয়। মূলত বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বিভিন্ন দেশে শিক্ষক দিবস পালন হতে থাকে। একজন শিক্ষক, যাকে স্কুল শিক্ষক বা আনুষ্ঠানিকভাবে একজন শিক্ষাবিদও বলা হয়; তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যিনি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের অনুশীলনের মাধ্যমে জ্ঞান, যোগ্যতা বা গুণ অর্জন করতে সাহায্য করেন।

তবে শিক্ষক শব্দের গভীরতা বোঝার জন্য শিক্ষক শব্দটি কোথা থেকে এলো এবং কেন এলো, তাও আমাদের জানতে হবে। শ বর্ণের অর্থ হলো তনুকারক, নাশক কিংবা মঙ্গল। মূলত শ শক্তি বিচ্ছুরণের প্রতিনিধিত্ব করে এবং শ সূর্যকিরণসদৃশ সর্বদিকগামী শক্তি বোঝায়। জ্ঞানের নিরিখে দেখলে শ অখন্ড জ্ঞান এবং আবিষ্কারমূলক করণ। আলোর নিরিখে দেখলে শ হলো দিবালোক। এক কথায় সর্বমুখী বিচ্ছুরণকারী শক্তির আঁধার হলো শ। শি হলো বিচ্ছুরিত গতিশীল শক্তি যাহাতে। আর শিক্ষ্‌ হলো গতিশীল বিচ্ছুরিতের ক্ষ-অন যাহাতে। আর যিনি নেপথ্যে এই শক্তি বিচ্ছুরণ করেন তিনিই শিক্ষক। কিংবা বলা যায়, যিনি জ্ঞানের আলো সূর্যের মতো চতুর্দিকে বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে সবকিছু আলোকিত করে নতুন দিবসের উন্মেষ ঘঁটান, তিনিই শিক্ষক। সুতরাং হৃদয়কে আলোকিত করার জন্য অবশ্যই একজন শিক্ষকের প্রয়োজন। শিক্ষক ব্যতীত কোনো মানবসন্তান নিজেকে কখনো আলোকিত করতে পারেনি কিংবা পারে না। শিক্ষকরা সমাজ পরিবর্তনে এবং শিক্ষার্থীদের সামাজিকীকরণে ও তাদের মধ্যে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের ভিত তৈরিতে বাতিঘর হিসেবে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। শিক্ষক প্রথমে নিজে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং পরে নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলে স্বীয় আদর্শ দ্বারা জাতীয় আকাঙ্ক্ষার উপযোগী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলেন। তাই সমাজ ও দেশের জন্য শিক্ষকের অবদান অপরিসীম। শিক্ষা হলো জাতির মেরুদন্ড আর শিক্ষক হলেন কান্ডারি। মানুষের জীবনে মা-বাবার পরই জীবন গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন শিক্ষক। শিক্ষকদের স্মরণ করা এবং তাদের সম্মান জানানো আদব শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। আর আদব ও শৃঙ্খলা অর্জনের মাধ্যমেই মানুষের জীবনে শিক্ষার পূর্ণতা ঘটে।

শিক্ষকতাকে আর দশটা গতানুগতিক পেশার মতো না দেখে পূর্বের ন্যায় এটাকে মহান পেশা হিসেবেই দেখতে হবে। যুগ যুগ ধরে শিক্ষকরা যে মর্যাদা পেয়ে এসেছেন, তা যেমন তাদের দিতে হবে, অপরদিকে তাদেরও সম্মান ধরে রাখার জন্য স্বচেষ্ট হতে হবে। মহামানব, মহাপুরুষ, ধর্মপ্রচারক, রাজা-বাদশা সবাই শিক্ষকের মর্যাদা দিয়েছেন এবং এখনো দিচ্ছেন। পবিত্র কোরআনে নাজিলকৃত প্রথম আয়াতে জ্ঞানার্জন ও শিক্ষা-সংক্রান্ত কথা বলা হয়েছে। আলস্নাহ তাআলা ইরশাদ করেন, 'পড়! তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্তপিন্ড থেকে। পড়! আর তোমার প্রতিপালক পরম সম্মানিত। যিনি কলমের দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।' সুরা আলাক, আয়াত-১-৫।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, 'আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে বা আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।' তিনি আরও বলেছেন, 'তোমরা জ্ঞান অর্জন কর এবং জ্ঞান অর্জনে আদব শিষ্ঠাচার শিখো এবং যার কাছ থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন করো, তাকে সম্মান করো।' মূলত সমাজে শিক্ষকদের সম্মানের দৃষ্টিতে দেখার ঐতিহ্য ও রীতি বেশ প্রাচীন। শিক্ষা অনুযায়ী, মানবচরিত্র ও কর্মের সমন্বয় সাধনই হচ্ছে রাসুলুলস্নাহ (সা.) এর তাগিদ। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আলস্নাহর পর, রাসুলের পর ওই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা মহানুভব যে, জ্ঞানার্জন করে ও পরে তা প্রচার করে।' (মিশকাত শরিফ)

সংস্কৃততেও একটি কথা আছে, গুরু শিষ্যকে যদি একটি অক্ষরও শিক্ষা দেন, তবে পৃথিবীতে এমন কোনো জিনিস নেই, যা দিয়ে সেই শিষ্য গুরুর ঋণ শোধ করতে পারে। বাদশাহ আলমগীর অমর হয়ে আছেন আজও সেই কাজী কাদের নেওয়াজের বিখ্যাত কবিতার উচ্চারণে, 'আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির।' প্রতিটি ধর্মগ্রন্থে শিক্ষকের মর্যাদা ও সম্মানের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সক্রেটিস, অ্যারিস্টোটল, পেস্নটোর মতো শিক্ষকরা জীবদ্দশায় সম্মান না পেলেও আজও তারা মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছেন।

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগে পালিত হয় দিবসটি। এ উপলক্ষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও সেমিনারের পাশাপাশি শিক্ষকদের সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। কিন্তু এত আনুষ্ঠানিকতার পরও শিক্ষকের মর্যাদার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত অর্জন নিয়ে আমাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে। গতানুগতিক ধারায় কেবলমাত্র দিবস পালনের মাধ্যমে সফলতা অর্জন হচ্ছে কিনা, তাও ভেবে দেখা দরকার। মূলত সময় বলছে, শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না কিংবা তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। আবার কেউ কেউ বলছেন, কতিপয় শিক্ষকের নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে শিক্ষক সমাজে মূল্যায়নের রাস্তাটি বন্ধুর হয়ে পড়েছে। ফলে অনেকেই তাদের যথাযথ মর্যাদা দিচ্ছে না। বরং এতে আরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

এর মধ্যে রয়েছে- শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, সুবিধাজনক কর্মস্থলের প্রত্যাশায় দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে ব্যস্ত থাকা, শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করা, ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যাপারে অবহেলা করা এবং সর্বোপরি অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা। এ ছাড়াও আরও অনেক কারণ থাকতে পারে, যা গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে স্থির করা আবশ্যক। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ছাত্ররাজনীতির কারণেও শিক্ষকরা ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না বা নিয়ন্ত্রণের ঝুঁকি নিতে রাজি হচ্ছেন না। এভাবে উভয়দিক থেকে দেখলে দেখা যাবে, কোথাও না কোথাও যেন এক ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায়, বর্তমান সমাজে শিক্ষককে মর্যাদা দেওয়ার পরিবর্তে বরং লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা অহরহ শোনা যাচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জা আর কী হতে পারে। শিক্ষকের অসম্মান ও অবমাননা এবং লাঞ্ছিত হওয়ার প্রকাশিত সংবাদ দেখে বিবেক চিৎকার করে ওঠে। এ বিষয়ে দ্রম্নত সেদিকে মনোনিবেশ করতে না পারলে সমাজের সমূহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

শিক্ষকদের থাকার কথা সমাজের সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে। মুখে মুখে আমরা যতই শিক্ষকদের মর্যাদার কথা বলি না কেন, বাস্তবে এর উল্টো পরিলক্ষিত হয়। আসলে শিক্ষকরা কেমন মর্যাদা পাবেন, তা নির্ধারণ করবে রাষ্ট্র তথা সরকার। ইউনেস্কো- আইএলও-এর ঘোষণা অনুয়ায়ী, শিক্ষকরা হবেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী নাগরিক। কিন্তু এর লেশ মাত্রও বাস্তবায়ন হয়নি আমাদের দেশে। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরও আমাদের দেশে শিক্ষকের মর্যাদার কোনো মানদন্ড নেই। মানব উন্নয়নের সূচকে এ দেশের শিক্ষা, শিক্ষকের অবস্থান ও অবদান সবচেয়ে বেশি হলেও আমরা এর মূল্যায়নে পিছিয়ে আছি। তাই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। শিক্ষকদের শিক্ষকতা পেশার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। যে সমাজে শিক্ষককে সম্মান দেওয়া হয় না, সে সমাজে ভালো মানুষ তৈরি হয় না। শিক্ষকের সম্মান দেওয়ার নজির ইতিহাসের পাতায় থাকলে চলবে না; বরং এর অনুশীলন করে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন নজির সৃষ্টি করতে হবে। সুতরাং আমাদের দাবি, বিশ্ব শিক্ষক দিবসটিকে শুধু পালন না করে চেতনায় লালন করে এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে রাষ্ট্র কর্তৃক যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে