পৃথিবীর চারটি নাতিশীতোষ্ণ ঋতুর মধ্যে শরৎ ঋতু একটি। উত্তর গোলার্ধে সেপ্টেম্বর মাসে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মার্চ মাসে শরৎকাল গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের মধ্যবর্তী ঋতু হিসেবে আগমন করে। বাংলার ষড়ঋতুর তৃতীয় এই ঋতুর দখলে আছে ভাদ্র ও আশ্বিন মাস। মূলত শরৎ হলো বর্ষার পরবর্তী ঋতু। বর্ষার অতিবর্ষণ ও অবিরাম মেগমলস্নারের ডামাডোল থেমে গিয়ে প্রকৃতিতে নেমে আসে শান্ত সুনিবিড় মনোহারী পরিবেশ। যে কারণে শরৎকালের প্রকৃতি হয় কোমল, শান্ত-স্নিগ্ধ ও উদার। ক্ষণিকের জন্য মাঝে মাঝে বৃষ্টিপাত হয়। নদী তার যৌবনের উন্মাদনা শেষে শান্ত হতে থাকে। আকাশ-বাতাসে কিংবা দুর্বাঘাসে শরৎ তার স্নিগ্ধ পরশ বুলিয়ে দেয়। শাপলা-শালুক, পদ্ম-জুঁই, কেয়া আর কাশফুলের সৌরভে শরৎরানি তার বীণার তারে সুর বাজিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। অসাধারণ সৌন্দর্যে ও সুবাসে ভরিয়ে দেয় চারদিক। যে কারণে ভালো লাগার দৃশ্য এবং ভালোবাসার হাতছানি কবিমনেও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এ সময় কাশের বুকে কোমল কাব্যের মতো ভেসে চলে সাদা-শুভ্র পেঁজা পেঁজা নরম মেঘমালা। সূর্যের কিরণ হয় দীপ্তোজ্জ্বল আর বাতাস হয় অমলিন। শরতের মতো নীল আকাশ আর কোনো ঋতুতেই দেখা যায় না। শোভা ছড়ানো পুষ্পবন আর শস্যের শ্যামলতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে শরৎ। আর শরতের এই অপরূপ রূপ দেখে বাংলার কবি-সাহিত্যিক ও সুধীজনরা শরৎ ঋতুকে ঋতুর রাণী বলে অভিহিত করেছেন। শরতের আগমনে বাংলার প্রকৃতি দোয়েল, কোয়েল ময়না-টিয়ার মধুর গুঞ্জন ধ্বনিতেই কেবল মুখরিত হয় না, বরং কবিদের কাব্যের দুয়ার খুলেও বের হয়ে আসে অনাবিল আনন্দের পরশ। শরৎ রাতের রূপালি চাঁদের আলোয় যখন প্রকৃতি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তখন কবি-সাহিত্যিকদের মনোজগৎও আনন্দের আতিশয্যে উদ্বেলিত না হয়ে পারে না। তাই যুগ যুগ ধরে হাজারও কবি-মহাকবি শিল্পী-সাহিত্যিক শরৎ নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য পদাবলি। প্রকৃতির এই অনন্যসুলভ রূপসৌষ্ঠব জনমানুষের দোরগোড়ায় সঞ্চারিত করতে সৃষ্টিধারায় অব্যাহত আছে নতুন নতুন সাহিত্যকর্ম। বাংলা সাহিত্যের গুরু কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শরৎ নিয়ে প্রচুর কবিতা ও গান রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও সুবাসিত করেছেন। তিনি তার সুরের ধারায় ব্যক্ত করেছেন- 'শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ছড়িয়ে গেল, ছড়িয়ে গেল/ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন আঙ্গুলি। শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি। শরৎ তোমার শিশির ধোওয়া কুন্তলে/বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে, আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি/শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি।'
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশির ভাগ রচনায় রয়েছে প্রকৃতির জয়গান। তিনি পদ্মায় নৌকা ভ্রমণকালে শরতের ময়ূরকণ্ঠী নীল নির্মল আকাশের শিমুল তুলার মতো শুভ্র মেঘেদের দলবেঁধে ছুটে বেড়ানো দেখে লিখেছিলেন, 'অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া/দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।' তবে শরৎকে কবি রবীন্দ্রনাথ বরাবরই দেখেছেন শান্তি, মঙ্গল ও সমৃদ্ধির ঋতু হিসেবে। তাই তিনি বলেছেন- আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা-/নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা/এসো গো শারদলক্ষ্ণী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে/এসো নির্মল নীলপথে।'
শরৎ বন্দনায় এগিয়ে রয়েছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি তার অসংখ্য গান ও কবিতায় শরতে বাংলার প্রকৃতির নিখুঁত চিত্র এঁকেছেন। তার 'শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ঐ' সহ অনেক গানই শরৎ প্রকৃতির লাবন্যময় রূপ নিয়ে হাজির রয়েছে। শরতের অসম্ভব চিত্ররূপময়তা ফুটে উঠেছে এসব রচনায়, 'এসো শারদ প্রাতের পথিক/এসো শিউলি বিছানো পথে।/এসো পদতল/নীল লাবনি ঝরায়ে ঢলঢল/ এসো অরণ্য পর্বতে।'
বাংলা সাহিত্য জগতেও মহাকবি কালিদাস মেঘদূত কাব্যের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন। মহাকবি কালিদাস শরৎ বন্দনায়ও ছিলেন অগ্রবর্তী। তিনি বলেন, 'প্রিয়তম আমার, ঐ চেয়ে দেখ/নববধূর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।' কবি ঋতুসংহার কাব্যে শরৎকাল বিষয়ে লিখেছেন,- কাশফুলের মতো যার পরিধান, প্রফুলস্ন পদ্মের মতো যার মুখ, উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয় যার নূপুরের নিক্বন, পাকা শালিধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহবলস্নরী, অপরূপ যার আকৃতি, সেই নববধূর মতো শরৎকাল আসে।' কবি কল্পনায় শরতের সঙ্গে প্রকৃতি ও নারীর এই উপমা দেখে বিস্ময়াভিভূত না হয়ে উপায় নেই। শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ শরৎকে অনুভব করেছেন খুব নিবিষ্টভাবে। সে জন্য শরতের রূপ-রঙ তার চোখে ধরা পড়েছে অন্যভাবে। তার এখানে নীল আকাশ কবিতা থেকে 'এখানে আকাশ নীল নীলাভ/আকাশজুড়ে সজিনার ফুল/ফুটে থাকে হিম শাদা রং তার/আশ্বিনের আলোর মতো। আকন্দ ফুলের কালো ভীমরুল এখানে করে গুঞ্জরণ/রৌদ্রের দুপুর ভরে বারবার/রোদ তার সুচিক্কণ চুন/কাঁঠাল জামের বুকে নিংড়ায়/দহে বিলে চঞ্চল অঙ্গুল।'
পলস্নীকবি জসীমউদ্দীনের কাছে শরৎ বিরহের কাল। এই ঋতুতে প্রিয় কাছে না থাকায় প্রেয়সীর যে বিরহরূপ তা তিনি কাছ থেকে অবলোকন করেছেন যেন। সে জন্য তিনি বলতে পারেন : 'গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল/আসিল ভাদ্র মাস/বিরহী নারীর নয়নের জল/ভিজিল বুকের বাস।' কবি বিনয় মজুমদার শরতের একটি চিত্র এঁকেছেন- শরতের দ্বিপ্রহরে, সুধীর সমীর পরে/জল ঝরা শাদা শাদা মেঘ উড়ে যায়/ ভাবি, একদৃষ্টে চেয়ে-যদি ঊর্ধ্ব পথ বেয়ে/ শুভ্র অনাসক্ত প্রাণ অভ্রভেদি ধায়।'
কবি আহসান হাবিবকে বলতে শুনি, 'এবার শরৎ রাত্রি স্বপন নয় এসেছে সঙ্গিন/লুণ্ঠিত স্বগের্র শীষে সে স্বপন রঙ্গিন/কেঁদে মরে মৃত্তিকায় মিশে যায় ধীরে/এবার শরৎ রাত্রি উদযাপিত হবে আঁখি নীড়ে।'
নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় শরৎ এসেছে জ্যোতি ছড়িয়ে। তার কবিতা 'জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে/নিমিষে শরতের শিশির জ্যোতিকতা।' শরতে প্রিয়ার রূপ-বন্দনায় ব্রতী হয়েছেন কবি নিমের্লন্দু গুণ। তার ছান্দিক অনুভব :সবে তো এই বর্ষা গেল/শরৎ এলো মাত্র/ এরই মধ্যে শুভ্রকাশে/ভরলো তোমার গাত্র।/শেষের আলে মুখ নামিয়ে/পুকুরের এ পাড়টায়/ হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে/বাঁশবনের ওই ধারটায়।' একেক জন কবি শরৎকে একেকভাবে দেখবেন- এটাই স্বাভাবিক। তাই কবি বন্দনায় বাংলার গ্রামীণ প্রকৃতিতে শরতের রূপের খোঁজ মেলে ভিন্ন ভিন্ন উপস্থাপনায়। পরিশেষে বলা যায়, শরৎ প্রকৃতিকে অপরূপ রূপে সাজিয়ে যায়- যার আবেশে অতি সাধারণ মানুষও ভাবাবেগে আপস্নুত হয়। আর সে কারণেই শরতে প্রাণবন্ত রূপ নানারূপে আবদ্ধ হয় কবিতায়, গানে, গল্পে, উপন্যাস ও প্রবন্ধে।