শিক্ষাই হলো জাতির মেরুদন্ড। আর প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সেই জাতি তত বেশি সভ্য ও উন্নত। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালেই তা বেঝা যায়। শিক্ষিত এবং সাক্ষরতা এক বিষয় নয়। একজন মানুষ যখন প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় তখন আমরা তাকে শিক্ষিত বলি। সাক্ষরতার সংজ্ঞা অনেক আগে থেকেই দেশে দেশে এক এক রকম প্রচলিত থাকলেও ১৯৬৭ সালে ইউনেস্কো প্রথম সাক্ষরতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। কেউ নাম লিখতে পারলেই তাকে সাক্ষর বলা হতো। বর্তমানে সাক্ষরতা হিসেবে তাকে ধরা হয় যে তিনটি শর্ত পালনে সক্ষম। যে ব্যক্তি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারবে, সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারবে এবং দৈনন্দিন জীবনে সাধারণ হিসাব-নিকাশ করতে পারবে তবেই তাকে সাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন বলা হবে। সারা বিশ্বে এখন এই সংজ্ঞাকেই ভিত্তি করে সাক্ষরতার হিসাব করা হচ্ছে। আগামী ৮ সেপ্টেম্বর হচ্ছে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের শিক্ষার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ ভাগ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জনশক্তি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের সাক্ষরতার হার ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশ।
বিবিএস ২০২২ সালকে ভিত্তি ধরে জনশক্তি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ বছরের মধ্যে এবং তার ওপরে যাদের বয়স তাদের সাক্ষরতার হার ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশ। গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলে এ সাক্ষরতার হার ১০ শতাংশ বেশি। শহরাঞ্চলে ৮৪ দশমিক ৮ শতাংশ সাক্ষরতার হারের বিপরীতে গ্রামাঞ্চলের সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৬ শতাংশ। নতুন এ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুরুষের তুলনায় নারী সাক্ষরতার হার প্রায় ৪ শতাংশ কম। যেখানে পুরুষ সাক্ষরতা ৭৯ দশমিক ৫ শতাংশের বিপরীতে নারী সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৮ শতাংশ।
তবে ১৫ থেকে ২৯ বয়সি যুব নারী-পুরুষের মধ্যে সাক্ষরতার হারের ব্যবধান যৎসামান্য। এ বয়সি পুরুষদের সাক্ষরতার হার ৯৫ শতাংশ এবং নারীদের ৯৫ দশমিক ৯ শতাংশ। যুব সাক্ষরতার হার শহরাঞ্চলে ৯৬ দশমিক ২ শতাংশ, যার মধ্যে নারী ৯৬ দশমিক ৭ শতাংশ ও পুরুষ সাক্ষরতা ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে যুব সাক্ষরতার হার পুরুষদের ক্ষেত্রে ৯৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং নারীদের ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
তবে বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার বাড়লেও শিক্ষিতের হার বেড়েছে বলে মনে হয় না। দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য সুযোগ উলেস্নখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেলেও বিগত বছরে বিদেশে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্য সূত্র মতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা শতাধিক হওয়া সত্ত্বেও মানসম্মত উচ্চশিক্ষার অভাব, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং দেশে কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগসহ বেশ কয়েকটি কারণে শিক্ষার্থীদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা কমানো যাচ্ছে না।
ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে অন্তত ৪৯ হাজার ১৫১ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ৫৮টি দেশে পড়াশোনার জন্য গিয়েছেন। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৪ হাজারের কিছু বেশি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৬ হাজারের কিছু বেশি। ২০০৮ সাল থেকে উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে তৎকালীন সরকার ২৫টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে এবং ৫৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে। বর্তমানে দেশের ৫৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও তাদের অধিভুক্ত কলেজ এবং ও ১১১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় অর্ধ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, অধিকাংশ নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, দক্ষ শিক্ষক ও গবেষণা সুবিধার অভাব রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, শিক্ষকদের রাজনীতিতে জড়ানো। প্রশ্ন হলো শিক্ষকরা কেন রাজনীতি করবেন? তাদের কাজ শিক্ষকতা করা। শিক্ষার মান বজায় রেখে ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞান বিতরণ করা এবং একজন ছাত্রকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে তৈরি করা। এদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বিশ্ববিদ্যালয় বানানো হচ্ছে কিন্তু সেখানে পড়াশোনার মান নিশ্চিত করতে পারছে না। শিক্ষক-ছাত্র সবাই মিলে রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। শিক্ষকরা বা ছাত্ররা কেন লেজুরভিত্তিক রাজনীতি করবে। এদেশে রাজনীতি মানে হিংসা, হানাহানি, ক্লাস বর্জন, শিক্ষক-ছাত্র দ্বন্দ্ব, শিক্ষা ক্ষেত্রে সেশনজট ইত্যাদি। এসব নানাবিধ কারণে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থা কারণে শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাচ্ছে।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান পরিমাপের কোনো ব্যবস্থা নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিকর্ যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পারফরম্যান্স খুবই খারাপ।
২০২৩ সালের টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির্ যাংকিং অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ৬০১ থেকে ৮০০তম স্থানের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) রয়েছে ১ হাজার ২০২ থেকে ১ হাজার ৫০০ এর মধ্যে। ১৩টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে ১০৪টি দেশের ১ হাজার ৭৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে এইর্ যাংকিং করা হয়েছিল।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক টাইমস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র?্যাংকিং ২০২৩-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৮৬তম এবং নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ১৯২তম স্থানে রয়েছে। এইর্ যাংকিং করা হয়েছে ৩১টি অঞ্চলের ৬৬৯টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে।
বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। এজন্য 'আগে তো শুধু উচ্চবিত্ত কিংবা খুব মেধাবী শিক্ষার্থীরাই বিদেশে পড়াশোনা করতে যেত। কিন্তু এখন আর্থিক সচ্ছলতার কারণে উচ্চ-মধ্যবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত পরিবারও তাদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠাতে পারে। এ ছাড়াও, দেশে সীমিত চাকরির বাজার, সেখানেও স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কারণে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দেন। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশের ঘাটতি রয়েছে। বেশিরভাগেরই শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা সুবিধা এবং মানসম্পন্ন ফ্যাকাল্টিও নেই। দুঃখজনকভাবে এটা সত্যি যে, এ দেশে শিক্ষার বিষয়টি কেবল পরীক্ষা ও সনদকেন্দ্রিকই, জ্ঞানকেন্দ্রিক নয়। এদেশে সংখ্যার দিকে জোর দেওয়া হয়, মানের দিকে জোড় দেওয়া হয় না। বিদেশে পড়তে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশ মেধা বাইরের দেশে চলে যাচ্ছে। কেননা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে আসার হার খুবই কম। এর ফলে দেশ মেধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। আগামী ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। তাই এই দিবস উদযাপনে আমাদের আশা ও বিশ্বাস দেশ এর থেকে পরিত্রাণ পাবে। বাস্তবায়ন হোক শতভাগ সাক্ষরতা এবং মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা।