বৈষম্যবিরোধী কবি কাজী নজরুল
প্রকাশ | ২৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
আজহারুল ইসলাম আল আজাদ
ভোরের পাখির গান ঝর্ণার কান্না অনেক। কিশোরের শোনা বা বোঝার সময় হয়ে উঠে না। বয়ে যাওয়া নদীর স্রোত কোন সুদূরে ছুটে চলে দেখার সাধ মিঠে না। আঘাতে আঘাতে বুকের ভেতরের চাপা কান্না হয়ে আসে কবির কবিতা। স্নেহ ভালোবাসা প্রেম-প্রীতি, রাগ-অনুরাগ, বিরাগ-বিরহ, দুঃখ-কষ্ট হাসি-কান্নার মধ্যে মানবজীবন শুরু আর এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই মানব জীবনের অবসান। কেউ আসে কেউ চলে যায় কেউ কর্মে মহান, কেউ কর্মে অধম। কৃর্তিমান কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খ্রিঃ ২৪ মে (১১ জৈষ্ঠ্য ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মৃতু্যবরণ করেন ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিঃ। পিতা ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুনের পুত্র তিনি। তার নাম রাখা হয় নজরুল ইসলাম। জীবনের প্রথম প্রহর কেটে যায় তার অনেক কষ্টে ও দুঃখে। গ্রামের লোকজন তার নাম রাখেন দুখু মিয়া। দুখু মিয়া মানুষ হিসেবে উপরোক্ত গুণাবলীর অধিকারী থাকাই স্বাভাবিক। ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। কিন্তু তিনি শিক্ষাঙ্গনে টিকতে পারলেন না। আট বছর বয়সে তর বাবা মারা গেলেন। নিজের কাঁধে পড়ল ভরন পোষনের দায়িত্ব। কাজের খোঁজে বেড়িয়ে পড়েন, প্রভূ কাউকে অনাহারী রাখেন না। তিনি কাজে নিয়োজিত হলেন ফলে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল। চায়ের দোকানের কাজ নিলেন, কিন্তু সেখানেও মন টিকল না। বাবা মসজিদের ইমামতি করতেন, সেই কাজে যোগ দিলেন। বাঁধন ছেড়া বালক, কারও শাসন তার ভালো লাগে না, সে কাজ তিনি ছেড়ে দিলেন। আবার চলে এলেন চায়ের দোকানে। সেখানে পরিচয় হলো এক মিলেটারির সঙ্গে। তিনি তার লেখাপড়ার দায়িত্ব নিলেন। তার সঙ্গে তিনি চলে গেলেন। তিনি কিশোর নজরুলকে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করালেন, কিন্তু সেই মিলেটারি বদলিজনিত কারণে অন্যত্র চলে গেলেন। কি ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, নজরুল আবারও নিজ এলাকায় চলে এলেন। এসে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করলেন। তিনি অভাবের কারণে যোগ দিলেন বাঙালি পস্নাটুনে। সেখানে আড়াই বছর কাজ করার পর ছাঁটাই হলেন। চলে এলেন নিজ এলাকায়। কি করবেন স্থির কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, লেটো গানের দলে যোগ দিলেন। শুরু হল তার সাহিত্যচর্চা।
সে সময় ব্রিটিশ শাসকদলের অত্যাচার-নির্যাতন-নিপিড়ন-জুলুমে জনজীবন বিপন্ন, তরুণ কবির হৃদয়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। সমাজের উঁচু-নিচুর বৈষম্য কবিকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি দেশের হালচাল ও অসম অবস্থা দেখে বিদ্রোহী হয়ে উঠেন। তিনি অসংখ্য কবিতা গল্প প্রবন্ধ নাটক একাংকিকা, উপন্যাস রচনা করলেন। অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ছন্দ হিলেস্নাল, ভাঙার গান, দোলন চাপা, ছায়ানট, কুহেলিকা ইত্যাদি। 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতা লিখে কবিকে জেলে যেতে হলো। জেলে বসেই কবি লিখলেন- আজ সৃষ্টি সুখের উলস্নাসে/মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর/টগবগিয়ে খুন হাসে। তিনি জেলে বসে লিখেন রাজবন্দির জবানবন্দি। তিনি সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। পচনধরা সমাজকে কবি তার লিখনির মাধ্যমে সচেতন করার চেষ্টা করেন। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে কবির জাতীয়তাবাদী সক্রিয়তার কারণে তাকে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের দ্বারা বারবার কারাবরণ করতে হয়।
১৯২০ সাল, কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে বাঙালি পস্নাটুন ভেঙে দেওয়ার পর কবি কলকাতায় ফিরে আসেন এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পরিষদে অবস্থান করেন। ১৯২২ সালের ২২ অক্টোবর ধুমকেতু পত্রিকার প্রথম সংখায় তার 'বিদ্রোহী' কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এই কবিতার মাধ্যমে কবি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। প্রমথ চৌধুরী কবিতাটি পাঠ করেন এবং কবিকে বিদ্রোহী কবি হিসেবে উপাধি দেন। এভাবেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে উঠেন বৈষম্যবিরোধী বিদ্রোহী কবি।