উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি প্রগতিশীল প্রণোদনার সাম্যবাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম জন্ম নেন ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ, ২৪ মে ১৮৯৯ সালে। মা-বাবার দুঃখী ছেলে দুখু মিয়া কালেভেদে একজন খ্যাতনামা বিদ্রোহী, সাম্যবাদী, অবহেলিত, নিপীড়িত মানুষের কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ছিলেন একাধারে নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, দার্শনিক, ঔপন্যাসিক। নানা গুণে তিনি গুণান্বিত বাংলা কাব্যের প্রথিতযশা কবি। বাংলা সাহিত্যে তার বিভিন্ন জায়গায় পদচারণা ছিল, কিন্তু তিনি কবি হিসেবে সবার অন্তরে। যে যুগে নারী সমাজ ছিল অবহেলিত, ঘরকুনো, বলতে গেলে একেবারেই বন্দিদশায়। তিনি এসব একবারেই সহ্য করতে পারেননি। তাই হাতে তুলে নিয়েছিলেন কলম আর সে কলমের তীক্ষ্ন খোঁচায় পোড় খাওয়া সমাজের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করেছেন। তিনি ছিলেন নারীবান্ধব বৈষম্যবিরোধী কবি, তিনি তার লেখনীতে কখনো নারীসমাজকে ছোট করেননি। তিনি জাতপাত তুলে সাম্যের গান, মৈত্রের গান গেয়েছেন। নারী-পুরুষকে সমানভাবে দেখেছেন। নারী কবিতায় তিনি লিখেছেন, সাম্যের গান পাই/আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই/বিশ্বে যা কিছু চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অনেক তার নর/শক্তি দিয়েছে প্রেরণা দিয়েছে বিজয়া লক্ষ্ণী নারী।
গানে কবিতায় সমানভাবে তিনি নারীদের মর্যাদা দিয়েছেন। পুরুষের শৃঙ্খল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার আহ্বান করেছেন। তিনি গেয়েছেন 'জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা/জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টীকা/দিকে দিকে মেলি তব লেলিহান রসনা/নেচে চলে উম্মাদিনী দিগবসনা/জাগো হতভাগিনী ধর্ষিতা নাগিনী।' নজরুলের সাহিত্য নারীকে বাদ দিয়া কল্পনা করা যায় না। তিনি নারী চরিত্রগুলো সৃষ্টিশীলতা দিয়ে সৃজন করেছেন। নিজেই ভেঙেছেন আবার গড়েছেন কাব্যে অশ্রম্নজলে, হাসিতে, কান্নায়। তিনি নারীকে কখনো সৃষ্টিসুলভ কল্পনা দিয়ে নয়, বাস্তবতা দিয়ে স্বমহিমায় নারীকে সৃষ্টিকর্মে এনেছেন। তার আজীবন লড়াই ছিল শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তির পথে। কবিতা আর গানে আশ্চর্যজনকভাবে নারীর কথা বলেছেন, যারা সবসময় প্রেমিক, প্রেয়সী, মমতায় মাতৃসম, কিন্তু অন্যায়ে বজ্রের মতো দৃঢ়সম কঠিন। ভালোবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ নিয়েই তিনি ছিলেন।
স্বমহিমায় তিনি নারী মুক্তির কথা ভেবেছিলেন। তাই নারীর পশ্চাৎপদতা ও তাদের ওপর সমাজ-ধর্ম-গোষ্ঠীর সংকীর্ণতা এবং বৈষম্যে নজরুল সবসময়ই বিচলিত ছিলেন। তিনিই ভেবেছিলেন নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিও। তাই তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, 'তুমি নহ নিভে যাওয়া আলো, নহ শিখা/তুমি মরীচিকা/তুমি জ্যোতি/জন্ম-জন্মান্তর ধরি' লোকে-লোকান্তরে তোমা করেছি আরতি/বারে বারে একই জন্মে শতবার করি!/যেখানে দেখেছি রূপ, করেছি বন্দনা প্রিয়া তোমারেই স্মরি।'
তার সৃষ্টি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গান সবকিছুতেই নারীকে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ আত্মমহিমায় উপস্থাপন করেছেন তার প্রতি সৃষ্টিকর্মে নারীকে কখনো অনুজ্জ্বল রাখেননি। তিনি একদিকে নারীকে অকৃপণভাবে ভালোবেসেছেন। আবার নারীর কাছে নানাভাবে ঋণ স্বীকার করে তার সাহিত্যকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। নারীর মহিমা-কীর্তনে তিনি ছিলেন আধুনিকমনস্ক। নারী কবিতায় তিনি লিখেছেন 'সাম্যের গান গাই/আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই/বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।'
নারীকেও তিনি রুখে দাঁড়াতে বলেছেন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে। মাথা তুলে বাঁচতে বলেছেন। নিষ্প্রাণ মাটির ঢেলা থেকে তাকে মানুষরূপে জেগে উঠতে বলেছেন। তাই 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতা শুরু করেছেন এভাবে 'আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।/দেব-শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,/ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?
নারী একজন মানুষকে যেমন দুঃখী করতে পারে, তেমনি নারীই হতে পারে পার্থিব জীবনের সব সুখের আঁধার। নজরুল সাহিত্যে নারী শুধুমাত্র প্রিয়তমা নয়, এসেছে মাতা, জায়া, ভগ্নি, কন্যারূপেও। নারীই যে পুরুষের চূড়ান্ত আশ্রয়স্থল, তা তার লেখনীতে প্রকাশিত হয়েছে। সাম্যবাদে নারী জাতিকে দূরে রেখে কখনো সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। তাই তিনি সাম্যবাদের এই জাগরণে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তাদের জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। তিনি আজীবন নারীর বন্দনা করেছেন নারীকে জাগাতে চেয়েছেন বহ্নিশিখারূপে সৃষ্টির অর্ধেকের কৃতিত্ব দিয়েছেন নারীকে।
আবার প্রেমিকা হিসেবে বলেছেন, 'মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী, দেবো খোঁপায় তারার ফুল।' নজরুল নারীকে রক্ষণশীলতা ও অবরোধ থেকে মুক্ত করতে প্রতিনিয়ত আহ্বান জানিয়েছেন। আর প্রতীক হিসেবে অলংকারকে চিহ্নিত করেছেন। তিনি লিখলেন, চোখে চোখে আজ চাহিতে পার না হাতে কলি পায়ে মল/মাথার ঘোমটা ছিড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও শিকল/যে ঘোমটা তোমা করিয়াছে ভীরু, ওড়াও সে আবরণ/দূর করে দাও দাসীর চিহ্ন যেথা যত আভরণ।
সবশেষে এ কথ বলে এখানেই সমাপ্তি টানছি, নজরুল বলেছেন- অসৎ চরিত্রের জন্য যেমন নারী পতিতা হয়, তেমনি চারিত্রিক দোষে নরকেও পতিত করা উচিত। নর ও নারীকে সামাজিক মর্যাদায় সমানভাবে প্রতিষ্ঠিত করার আকাঙ্খা থেকেই বীরাঙ্গনা কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেছেন- অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ পুত্র হয়/অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়।