বিকাল ৪টা বেজে ১০ মিনিট বুধবার ১৪ আগস্ট, কেন্দ্রীয় কমিটির বন্ধুরা এক এক করে হাজির হলেন ঢাকার পুরানা পল্টন মোড়ে। উদ্দেশ্য যানজটমুক্ত নিরাপদ গন্তব্য এই প্রতিপাদ্যে গাড়ি দুর্ঘটনা রোধ ও ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা। সবার উপস্থিতির পর বন্ধুরা যানবাহন চালকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে সচেতন করতে সড়কে নেমে পড়েন। টেকসই জনসচেতনতামূলক এ ট্রাফিক ক্যাম্পেইন কর্মসূচিতে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করে। মাইকিং করে সড়কে সবাইকে আইন মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রচার কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়। যায়যায়দিন ফ্রেন্ডস ফোরামের বিভাগীয় সম্পাদক জ্যোতিষ সমাদ্দার বাবুর নেতৃত্বে ট্রাফিক আইন নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কেন্দ্রীয় ফ্রেন্ডস ফোরামের বন্ধুদের নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন আহ্বায়ক শাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকায় যানজট সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ও নির্বিঘ্নে যান চলাচল নিশ্চিত করতে হলে ট্রাফিক আইন মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রী, চালক এবং পথচারীদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করা হয়। ফ্রেন্ডস ফোরামের 'যানজটমুক্ত নিরাপদ গন্তব্য' কর্মসূচিতে ট্রাফিক পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন সহযোগিতা করেন। মাসুম পারভেজ ও কাওছার আহমেদ মাইকিং করে মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন নিয়মগুলো বলতে থাকেন। সড়ক পথে দুর্ঘটনার হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমিয়ে এনে যানজট সহনীয় পর্যায়ে রাখতে আমাদের এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
ক্যাম্পেইন চলাকালে পল্টন মোড়ে পথচারী, যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন ফ্রেন্ডস ফোরামের বন্ধুরা ও সচেতনমূলক দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। যুগ্ম আহ্বায়ক শামীম আরা বেগম দিশা জানান, 'পুরানা পল্টন মোড়ে পথচারীদের মাঝে যে বিষয়গুলো আমাদের বেশি চোখে পড়ার মতো ছিল তা হলো জেব্রাক্রসিং ব্যবহারে অনীহা। যত্রতত্র রাস্তা পারাপার। সেই সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পারাপার হওয়া। এমন অনেক অসচেতন পথচারীদের হাত ধরে রাস্তা পারাপারের নিয়মগুলো বুঝিয়ে দেই এবং ফোনে কথা বলে রাস্তা পারাপারে নিষেধ করি। ক্যাম্পেইন চলাকালে বিভাগীয় সম্পাদক ও আহ্বায়ক নিজেরাও পথচারীদের নিয়ম মেনে পথ চলতে বাধ্য করান। পল্টন মোড়ে ক্যাম্পেইন চলাকালে সেখানকার ডিউটিরত ট্রাফিক সার্জেন্ট নূর আলম জানান, 'আমরা প্রতিদিন সড়কে কাজ করে যাচ্ছি পথচারীদের বুঝাচ্ছি এরপরও ওনারা নিয়ম মেনে চলেন না। আপনারা সড়কে যতক্ষণ থাকবেন এবং যতক্ষণ জোর করে তাদের বাধ্য করাবেন ওনারা ঠিক ততক্ষণি নিয়ম মেনে চলবে, এরপর আপনারাও চলে যাবেন ঠিক আগের মতোই যেমন অবস্থা সড়কে তেমনই থাকবে।' তিনি আরও জানান, শুধু মুখে বলে সচেতন নয় এর জন্য কঠিন আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে করে জনসাধারণ সব সময় নিয়ম মানতে বাধ্য হন। ফ্রেন্ডস ফোরামের কেন্দ্রীয় এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক শামিমা আরা বেগম দিশা, সদস্য-সচিব আব্দুল হামিদ, যুগ্ম সদস্য সচিব মাসুম পারভেজ, নুরুল ইসলাম, সম্মানিত সদস্য মোহাম্মদ বশির উলস্নাহ, বিজয়কৃষ্ণ মন্ডল, আব্দুলস্নাহ আল মামুন, শারমিন আক্তার, জুবায়ের হোসেন, কেরানীগঞ্জের সভাপতি কাওসার আহমেদ প্রমুখ। এ ছাড়াও বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্য, যানবাহনের যাত্রী, চালক এবং পথচারীরা উপস্থিত ছিলেন।
পথ ক্যাম্পেইন শুরুর আগে আলোচনা সভায় সড়ক পথে গাড়ি দুর্ঘটনা রোধ এবং ট্রাফিক সচেতনতা নিয়ে কিছু দিক নির্দেশনা বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা হয়। টেকসই সচেতনতা ক্যাম্পেইন ও যানজটমুক্ত নিরাপদ গন্তব্য এ নিয়ে যদি সরকার, বাস মালিক, বাস চালক, যাত্রী ও পথচারী সবাই সচেতন হয় তবে যানজটমুক্ত একটি সুন্দর শহর পেতে পারি। সড়ক পথে গাড়ি দুর্ঘটনা রোধে চাই দক্ষ চালক ও জনসচেতনতা বিষয় নিয়ে বি.স. জ্যোতিষ সমাদ্দার বাবু তার দীর্ঘদিনের গবেষণালব্ধ পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছু নিয়ম-কানুন তুলে ধরেন। তার কিছু চুম্বক অংশ এখানে লিপিবদ্ধ করা হলো।
সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। তাই সময় ও জীবনকে পাশাপাশি রেখে সর্বোচ্চ সতর্কতা নিয়ে যানবাহন চালনা ও যানবাহনে চলাচল করা উচিত। গবেষণায় দেখা যায়, সড়কগুলোতে প্রতিদিন যত গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটে তার বেশিরভাগই সামান্য ত্রম্নটি, ওভার স্পীড ও ড্রাইভারের অসহিষ্ণুতার কারণেই হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের পরিসংখ্যান বলছে সড়ক পথে দুর্ঘটনায় কমবেশি প্রায় ১০ (দশ) হাজার লোকের মৃতু্য, ১৩ হাজার লোক আহত বা পঙ্গু হয় কিন্তু বাস্তবিক অর্থে আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কেননা সড়ক পথে দুর্ঘটনা নিয়ে কেন্দ্রীয় কোনো মনিটরিং সেল নাই। বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন রকম রিপোর্ট প্রকাশ করে। অসহিষ্ণুতা পরিহার করে সচেতন হলেই এ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। সরকার, গাড়ির মালিক, চালক, সাধারণ যাত্রী, পথচারী সবারই সড়ক পথে গাড়ি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এগিয়ে আসা দরকার। অপরদিকে যানজট কমলে দৈনিক কর্মঘণ্টা বেড়ে যাবে যাতে করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও বাড়বে। প্রয়োজন শুধু সবার আন্তরিক ব্যক্তি সচেতনতার, গড়ে তুলতে হবে সামাজিক নৈতিকতার আন্দোলন।
সড়ক পথে গাড়ি দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও যানজট নিরসনে
করণীয় বিষয়ে আলোকপাত করা হলো।
সরকারের প্রতি আহ্বান :প্রশিক্ষিত চালক তৈরি করার জন্য একাডেমিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করা, যাত্রী বীমা ও গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট নিশ্চিত করা, দূরপালস্নার সব বাসে গতিমিটারটি সচল রাখার নির্দেশনা, সব হাইওয়েতে ও সিটি কর্পোরেশনের রাস্তায় সড়কদ্বীপের উচ্চতা ১ (এক) মিটার এবং শহরের সড়কদ্বীপে সবুজায়ন কর্মসূচি নেওয়া, প্রতিটি মোড়ে জেব্রাক্রসিং ও প্রয়োজনীয় স্থানে স্পিড ব্রেকার নিশ্চিত করা, যথাযথস্থানে ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস তৈরি করা, হাইওয়েতে রাস্তার ওপর বাজার ও বাসস্ট্যান্ড বন্ধ করা। জেলা বা উপজেলার সঙ্গে বাস যোগাযোগে 'সময় নিয়ন্ত্রিত' গাড়ি চালনা বন্ধের নির্দেশনা, সিটি সার্ভিস গণপরিবহণে গাড়ির মাঝামাঝি ১ (একটি) ১ (এক) মিটার প্রশস্ত মাপে দরজা ব্যবহার করার নির্দেশনা যাতে কম সময়ে বেশি যাত্রী উঠানামা করতে পারে। এতে বিশেষ করে গাড়িতে যাত্রীও বেশি হবে এবং মহিলা যাত্রীদেরও সুবিধা হবে, নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ ব্যতিত যাত্রী উঠানামা করা ও সিগনাল না থাকলে রাস্তার মোড়ের ১০০ মিটারের মধ্যে গাড়ি না থামানোর নির্দেশনা। স্কুল, কলেজ, হাসপাতালের সামনে এবং ব্যস্ততম রাস্তায় গাড়ি পার্কিং ও সিটি কর্পোরেশনের ডাস্টবিন না রাখা; লেন মেনে গাড়ি চালনা, চালকের লাইসেন্স ও গাড়ির কাগজপত্র বাসের যাত্রাপথের শুরু বা শেষ স্থানে ট্রাফিক সার্জনদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নির্দেশনা। মুখোমুখি গাড়ি ক্রসিংয়ে গতি ৪০ কিলোমিটারে সীমিত করা। হাইওয়ে ও মহাসড়কে ৬০ (ষাট) কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চালনা রোধে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে স্পিড ডিটেক্টর ডিজিটাল মেশিন ব্যবহার করা। দ্রম্নততার সঙ্গে সরকারিভাবে কেন্দ্রীয় জিপিএস পদ্ধতিতে গাড়ির গতি পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করার প্রকল্প গ্রহণ করা। রাজধানীতে গাড়ির রাস্তায় ভাসমান দোকান বন্ধ করা। স্কুল পাঠ্যক্রমে ৩য় থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ট্রাফিক নিয়ম-কানুন সন্নিবেশিত করা। প্রতিদিন প্রাত্যহিক সমাবেশে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর স্কুল শিক্ষার্থীদের ১ মিনিট ট্রাফিক সচেতনতা নিয়ে সচেতন করা। রাজধানীতে প্রবেশপথে জরুরিভাবে সিটি টার্মিনাল নির্মাণ বাস্তবায়ন করা। রাজধানীসহ দেশের সব বড় শহরের মধ্যে যানবাহন চলাচলের গতিবেগ নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখার নির্দেশনা ও বাস্তবায়ন। রাজধানীর প্রতিটি মোড়ে সার্বক্ষণিক মাইকিং করে ট্রাফিক নির্দেশনা দিয়ে জনসচেতনতায় সহায়তা করা। ভবিষ্যতের জন্য জ্বালানী সাশ্রয় করতে সিগন্যালে সব ধরনের গাড়ির স্ট্যার্ট বন্ধ রাখার নির্দেশনা প্রদান।
মালিকদের প্রতি আহ্বান :ত্রম্নটিপূর্ণ যানবাহন রাস্তায় নামাবেন না, লাইসেন্সধারী দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ড্রাইভার দ্বারা প্রতিযোগিতামূলক ওভারটেকিং না করে সহিষ্ণুতার সঙ্গে গাড়ি চালাতে নির্দেশনা, সময় নিয়ন্ত্রিত গাড়ি চালনা এবং ওভারলোডেড পণ্য পরিবহণ থেকে বিরত থাকা। সিটি সার্ভিস গণপরিবহণে গাড়ির মাঝামাঝি ১ (একটি) ১ (এক) মিটার প্রশস্ত মাপে অথবা বিআরটিসি বাসের দরজার মাপে দরজা তৈরি করুন। দূরপালস্নার সব বাসে গতিমিটারটি সচল রাখুন। গাড়িতে ফার্স্ট এইড বক্স রাখুন।
চালকদের প্রতি আহ্বান :ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ প্রয়োজনীয় কাগজ সঙ্গে রাখুন; রাস্তায় গাড়ি বের করার পূর্বে ব্রেক ক্লাচ, স্টিয়ারিং, হর্ন পরীক্ষা করুন। সর্বোচ্চ গতিসীমা মেনে নির্ধারিত লেনে গাড়ি চালান, সিগন্যাল দিয়ে লেন পরিবর্তন করুন, পথচারী পারাপারে জেব্রাক্রসিংয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক হোন, গাড়ি চালনার সময় মোবাইলে কথা বলবেন না, নির্ধারিত বাস স্টপেজে গাড়ি সাইড করে যাত্রী ওঠানামা করাবেন। হাইওয়েতে রাতে গাড়ির হেড লাইটের হাই বিম ও লো বিম নিয়ন্ত্রণে রাখুন, মুখোমুখি গাড়ি ক্রসিংয়ে গতি ৪০ কিলোমিটারে সীমিত করুন। ত্রিমোহনা রাস্তার সোজা (যেখানে বামে মোড় নেই) ও বাম মোড়ের লেন সবসময় ফাঁকা রেখে গাড়ি চালনা করুন। উল্টোপথে ও প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চালনায় বিরত থাকুন। ট্রাক চালকরা ওভারলোডেড পণ্য পরিবহণ থেকে বিরত থাকুন। মটর সাইকেল চালকরা ফুটপাত পরিহার করে নির্দিষ্ট গতিবেগে গাড়ি ড্রাইভ করুন। অযথা হর্ন বাজিয়ে শব্দদূষণ করবেন না। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য গাড়ির জ্বালানী বাঁচিয়ে রাখতে সিগন্যালে গাড়ির স্ট্যার্ট বন্ধ রাখুন।
যাত্রীদের প্রতি আহ্বান :মোবাইলে কথা বলতে বলতে চলন্ত গাড়িতে উঠানামা করবেন না। স্টপেজ ব্যতিরেকে যেখানে সেখানে গাড়ি থামানোর অনুরোধ ও চলন্ত অবস্থায় চালকের সঙ্গে খারাপভাবে কথা বলা এবং গাড়ির গতি বাড়িয়ে ওভারটেক করতে উৎসাহিত করবেন না। লাইন দিয়ে গাড়িতে উঠুন। একেবারে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ১৫ মিনিটের হাঁটাপথে গণপরিবহণে চলাচল করবেন না। গাড়ি থেকে নামার সময় বাস ড্রাউভারকে ধন্যবাদ দিন।
পথচারীদের প্রতি আহ্বান : ট্রাফিক আইন মেনে জেব্রাক্রসিং/ওভারব্রিজ/আন্ডারপাস দিয়ে রাস্তা পারাপার হউন। ফুটপাত দিয়ে বা যেখানে ফুটপাত নেই সেখানে রাস্তার ডান দিক দিয়ে (গাড়ির মুখোমুখি) চলাচল করুন, সিগন্যালে গাড়ি পুরোপুরি থামার পর ডান বাম দেখে রাস্তা পারপার হউন, শিশু এবং বৃদ্ধ পথচারীদের হাত ধরে রাস্তা পারপার করুন, রাস্তা পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন।
বিভাগীয় সম্পাদক ও যুগ্ম সদস্য সচিব, কেন্দ্রীয় কমিটি।