বৈষম্যবিরোধী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য স্মরণে

প্রকাশ | ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

খোন্দকার শাহিদুল হক
যে কবির কাব্যশক্তির ঝলকানিতে আলোকিত হয় মানবিক শক্তি, জাগ্রত হয় হৃদয়ে দ্রোহের বহ্নিশিখা এবং বিবেক উজ্জীবিত হয় অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সেই কবি হলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী এই তারুণ্যের কবি অতি অল্প সময়ে অত্যাশ্চর্য কবিত্বশক্তির পরিচয় দিয়ে বিশ্বব্যাপী অর্জন করেন অশেষ খ্যাতি। তার পিতার নাম নিবারণ ভট্টাচার্য এবং মাতার নাম সুনীতি দেবী। তিনি ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট তার মাতামহের বাড়ি কালকাতার কালীঘাটে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলায়। কবি বেলেঘাটা দেশবন্ধু স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এই সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে যুক্ত হওয়ায় তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। কবি সুকান্ত আট-নয় বছর বয়স থেকেই লিখতে শুরু করেন। স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা 'সঞ্চয়ে' একটি ছোট্ট হাসির গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেন। তার দিনকয়েক পরে বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের 'শিখা' কাগজে প্রথম ছাপার মুখ দেখে তার লেখা বিবেকানন্দের জীবনী। মাত্র এগারো বছর বয়সে 'রাখাল ছেলে' নামে একটি গীতিনাট্য রচনা করেন। এটি পরে তার 'হরতাল' বইতে সংকলিত হয়। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাল্যবন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে আরেকটি হাতে লেখা কাগজ 'সপ্তমিকা' সম্পাদনা করেন। অরুণাচল তার আমৃতু্য বন্ধু ছিলেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। তাকে বলা হয় গণমানুষের কবি। অসহায়-নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের সুখ-দুঃখ তার কবিতার প্রধান বিষয় ছিল। অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে ধনী মহাজন অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে নজরুলের মতো সুকান্ত ছিলেন সক্রিয়। শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে তার ছিল দৃঢ় অবস্থান। তিনি তার কবিতার নিপুণ কর্মে দূর করতে চেয়েছেন শ্রেণিবৈষম্য। মানবতার জয়ের জন্য তিনি ছিলেন লড়াকু। অসুস্থতা অর্থাভাব তাকে কখনো দমাতে পারেনি। মানুষের কল্যাণের জন্য তার ছিল নিরন্তর ভালোবাসা। তিনি মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন। তার অগ্নিদীপ্ত সৃষ্টি প্রণোদনা দিয়ে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে প্রয়াসী ছিলেন। মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি তার বাংলা কাব্যধারার প্রচলিত প্রেক্ষাপটকে আমূল বদলে দিতে পেরেছিলেন। সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার (১৯৪৫) 'কিশোর সভা' বিভাগ সম্পাদনা করতেন। তার কবিতা অনাচার ও বৈষ্যমের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদী পাঠকদের আন্দোলিত করে তোলে। গণমানুষের প্রতি গভীর মমতা প্রকাশ ঘটেছে তার কবিতায়। তার রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য হলো : ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পীসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। সুকান্তের কবিতা বিষয় বৈচিত্র্যে ও লেখনীর দক্ষতায় অনন্য। সাধারণ বস্তুকেও সুকান্ত কবিতার বিষয় করেছেন। দিয়াশলাই কাঠি, বাড়ির রেলিং ভাঙা সিঁড়ি ওঠে এসেছে তার কবিতায়। সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবিলা করার সাহস তার কবিতা থেকে পাওয়া যায়। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান লক্ষণীয়। তার কবিতা সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। তার বক্তব্য প্রধান সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়। স্বল্প সময়ের জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যকে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জীবনানন্দ দাশসহ সে সময়ের বড় বড় কবির ভিড়ে তিনি হারিয়ে যাননি। নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন নিজ প্রতিভা, মেধা ও মননে। সুকান্ত তার বয়সের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছেন তার পরিণত ভাবনায়। তার যে পঙ্ি‌ক্ত আজও দীপ্তভাবে উচ্চারিত হয় তা হলো- ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল/এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।