মেহনতি শ্রমিকদের ঘামে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। এগিয়ে যায় দেশ। শ্রমিক শ্রেণিকে অবহেলা ও তাদের উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত না করে সামগ্রিক উন্নয়ন আশা করা যায় না। সফল হয় না অথর্নৈতিক, সামাজিক এবং সামগ্রিক উন্নয়ন। পহেলা মে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই গুরুত্বের সঙ্গে দিনটি শ্রদ্ধাভরে পালিত হয়। মেহনতি মানুষের জন্য দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও স্মরণীয়। কেবল দিবস হিসেবে নয়, বছরের প্রতিটা দিন যাতে শ্রমজীবী মানুষ তার ন্যায্য পাওনা, সম্মান এবং সহমর্মিতা পায় তার জন্য এই আয়োজন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে তাদের দাবির পক্ষে সেস্নাগানে মুখরিত হয় এবং যথাযোগ্য মর্যাদায় দিবসটি পালন করে থাকে। বিশ্বের প্রায় শতাধিক দেশে ১ মে জাতীয় ছুটির দিন। দেশে শ্রমিক বান্ধব আইনের পাশাপাশি শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার পাওনা পরিশোধ করার তাকিদ ইসলামেও রয়েছে। অথচ প্রতিনিয়ত শ্রমিকে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছে খেটে খাওয়া মজুর, শ্রমিক সমাজ।
আমাদের দেশে শ্রম আইন থাকলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাবে শ্রমজীবী সঠিক মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যা কোনোভাবেই উন্নয়নকামীদের কাম্য নয়। এমনকি শিশুশ্রম নিষিদ্ধ থাকলেও কম পারিশ্রমিকে খাটানোর কারণে অনেক হোটেল, ঝুঁকিপূর্ণ ওয়েল্ডিং কারখানায়, গৃহকর্মী হিসেবে, পরিবহণে, মিল কারখানায় শিশুদের ব্যবহার করা হচ্ছে। দেখা যায়, দেশের অর্থনৈতিক দুর্বল শ্রেণির শিশুরা সচ্ছলতার আশায় কারখানায় কাজ করছে। অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এই কোমলমতি শিশুদের কাজ করানো হচ্ছে। শিশুশ্রম নিষিদ্ধ 'কীতাবে আছে বাস্তবে নেই'। শিশুশ্রম বন্ধে তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করাও জরুরি।
শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও জীবন মানের পরিবর্তনে তাদের ন্যায্য অধিকার দেওয়া ছাড়া সামগ্রিক অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশের প্রত্যেকটি শ্রমজীবীর অধিকার আদায়ে শুধু একটি দিন নয় সব সময় সোচ্চার থাকা দরকার। মে দিবসের উদ্দেশ্য ও ভাবনাকে কাজে বাস্তব সম্মতভাবে রূপদান করা দরকার। নারী ও শিশু শ্রমিকদের দিকে আলাদা নজর দেওয়া কারখানা মালিকদের দায়িত্ব। মজুরি বৈষম্য এবং হঠাৎ করে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই অনেক মিল কারখানা বন্ধ করে দেয় মালিক পক্ষ। শ্রমিক ছাঁটাই খেটে খাওয়া মানুষকে কর্মচু্যত করা হলে বেকার হয়ে পড়া শ্রমিকরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। সেদিকেও কঠোর নজরদারি দরকার।
১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলিতে নিহত শ্রমিকদের স্মরণ ও তাদের দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশের মধ্য দিয়ে পালিত হয় মহান মে দিবস।
শ্রমিকের ন্যায্য দাবি, তাদের অধিকার, মর্যাদাকে সম্মান ও সমুন্নত রাখতে প্রতি বছর ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মহান মে দিবসের্ যালি, শোভাযাত্রা, মিছিল-সমাবেশসহ শ্রমিক গণজমায়েত করে তাদের অধিকার ও দাবি-দাওয়া তুলে ধরা হয়। হে মার্কেটের আন্দোলনরত শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে শ্রমিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন সেস্নাগান দিয়ে শ্রমিক ঐক্যের প্রতি সংহতি জানায়।
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, নারী শ্রমিকরা শুধু বেতনবৈষম্যই নয়, তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আমাদের পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় কর্মক্ষেত্রেই নারীসমাজকে পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে বিভিন্ন অজুহাতে। নারীদের পাশাপাশি শিশুশ্রমের ব্যবহারও চলছে অবাধে। যদিও কারখানা গেটে বড় হরফে লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে 'শিশুশ্রমিক নেই/ শিশুশ্রম নিষিদ্ধ'। কিন্তু বাস্তবতা উল্টো। অবশ্য আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দরিদ্রতাসহ বিভিন্ন কারণে শিশুশ্রম কমছে না। কারখানা মালিকপক্ষ শিশু ও নারীদের কম শ্রমমূল্যে খাটাতে অভ্যস্ত হওয়ার কারণেও শিশুশ্রম ঠেকানো যাচ্ছে না। কর্মক্ষেত্রে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারে শিশুশ্রমিকদের জীবন হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, অকালে ঝরে যাচ্ছে নিষ্পাপ শিশুর সম্ভাবনাময় জীবন। অনেক ক্ষেত্রে অপুষ্টির শিকার হয়েও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে শিশুশ্রমিকের জীবন। মজুরিবৈষম্যের পাশাপাশি অসৌজন্যমূলক আচরণের শিকার এসব শিশুশ্রমিক অপরাধী হয়ে বেড়ে উঠছে। সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হতে হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই শিশুদের। বর্তমানে মেয়ে শিশুশ্রমিক ও নারীশ্রমিকদের শারীরিক লাঞ্ছনাও দুর্বিষহ করে তুলছে তাদের জীবনকে।
শ্রমিক আন্দোলন থেকেই মে দিবসের সূচনা। ১ মে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায় ও অধিকার ফিরে পাওয়ার দিন। মেহনতি মানুষের জন্য দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও স্মরণীয় দিন। মে দিবসের এই মে মাসে সফলতার পাশাপাশি সব পেশার শ্রমিকের প্রতি আমাদের সরকার ও বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সুনজর প্রত্যাশা করি। জয় হোক বিশ্বের সব মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের। অধিকারপ্রাপ্তিতে সম্মান নিয়ে বাঁচুক বিশ্বের সব শ্রমজীবী এমন প্রত্যাশা আজ ও আগামীর।