আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস পালন করা হয় প্রতি বছর এপ্রিল মাসের শেষ বুধবার। বিশ্বব্যাপী এ দিবস পালিত হয় ঠিকই কিন্তু এ দিবস পালনের আসল উদ্দেশ্য তো বাস্তবায়িত হচ্ছে না। শব্দের আন্তর্জাতিক মানদন্ড না রাখলে শব্দদূষণ মারাত্মক একটি ব্যাধি হয়ে সমাজের বহু মানুষকে বধির করে দিবে। আমরা সচেতনতা অবলম্বন করলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। শ্রবণমাত্রার অতিরিক্ত শব্দ মানুষের শ্রবন ইন্দ্রিয়ের যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয় তা বলে বুঝানো যাবে না। এটি ধীরে ধীরে শ্রবণ শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়। সেজন্যই একটু বেশি বয়সের লোকদের সঙ্গে কথা বললে অনেক সময় অনেক জোরে কথা বলতে হয়। মানুষের শ্রবণ ইন্দ্রিয় দ্বারা নির্দিষ্ট মাত্রার শব্দই গ্রহণ করতে পারে। অতিরিক্ত জোরালো শব্দ মানুষের কানে বিরূপ প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ অনুসারে, এটি একটি দন্ডণীয় অপরাধ। বাংলাদেশে শব্দদূষণ বিধিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময়ে ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।
শব্দদূষণ এক ধরনের মারাত্মক পরিবেশ দূষণ। সঠিক অনুধাবনের অভাবে দিন দিন এ দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। অনেক পরিবেশবাদী বাংলাদেশের শব্দদূষণকে 'শব্দসন্ত্রাস' নামে অভিহিত করেছেন। উচ্চমাত্রার শব্দের প্রভাবে, যেমন- গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন, মাইকের আওয়াজ, আতশবাজির শব্দ, বিমানের শব্দ, কলকারখানার শব্দ ইত্যাদিতে মানুষের স্থায়ী বধিরতা হতে পারে, অথবা নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতাও দেখা যায়। তথ্যসূত্রে জানা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় শব্দের মাত্রা ৭৬ দশমিক ৮০ ডেসিবল। তিনটি সড়কের সংযোগ স্থলে সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ হয় সেগুলো হলো- নিউমার্কেট মোড় ১০০ দশমিক ৬৫ ডেসিবল, নয়াপল্টন মোড় ৯২ দশমিক ২২ ডেসিবল এবং প্রেস ক্লাব মোড ৯০ দশমিক শূন্য ৩ ডেসিবল। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় শব্দদূষণ মাত্রা ৮০ দশমিক ৫৬ ডেসিবল। যে তিনটি সড়কের সংযোগ স্থলে সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দদূষণ হয় সেগুলো হলো- মোহাম্মদ বাসস্ট্যান্ড মোড় ৯৯ দশমিক ৭৭ ডেসিবল, শিয়া মসজিদ মোড ৯৩ দশমিক শূন্য ৫ ডেসিবল এবং মাসকট পস্নাজা মোড ৯০ দশমিক ২৭ ডেসিবল। শব্দদূষণকে বলা হয় নীরব ঘাতক। ঢাকা শহরে শব্দদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কোথাও শব্দদূষণ আইন মানা হচ্ছে না বা এ নিয়ে সামাজিক সংগঠনগুলোর তৎপরতাও খুব বেশি নয়। শুধুমাত্র দিবস উপলক্ষ করে কিছু সভা সেমিনারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ কিন্তু এর ব্যাপক প্রচারণা নেই বলে এ শব্দ দূষণ সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি হচ্ছে না।
শব্দদূষণ মূলত একটি আপেক্ষিক বিষয়। শব্দ স্তরের গ্রহণযোগ্য পরিমাণ প্রায় ৬০-৬৫ ডেসিবেল, যা একটি সাধারণ কথোপকথনের সমান। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৮৫ ডেসিবেলের বেশি শব্দের মাত্রা কারও কারও শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার কারণ হতে পারে। রাস্তার মোড়ে যানজটের সময় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় গাড়ির ড্রাইভাররা অহেতুক বেশি মাত্রায় হর্নের ব্যবহার করে। ফলে অসহনীয় শব্দ ছোট বড় সবারই কানের ক্ষতি করছে। এর ফলে মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
শব্দদূষণের বিভিন্ন উৎসসমূহ বৃহৎ টেক্সটাইল মিল, ইঞ্জিনিয়ারিং পস্ন্যান্ট, প্রিন্টিং প্রেস, ধাতু শিল্প ইত্যাদি। গবেষণায় জানা যায় হার্ট অ্যাটাক-স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। যারা এসব পস্নান্টে কাজ করেন তারা যদি শব্দের প্রভাব কমাতে ইয়ারপস্নাগ পরার মতো যথাযথ ব্যবস্থা না নেন, তাহলে তারা বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন। এছাড়া সামরিক সরঞ্জাম যেমন- আর্টিলারি ট্যাংক, রকেট উৎক্ষেপণ, সামরিক বিমানের মহড়া, বিস্ফোরণ মারাত্মক শব্দদূষণকারী। নীরব এলাকায় হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ। কিন্তু গাড়ির হর্নে রীতিমতো অস্থির থাকে ওইসব নীরব এরিয়ায়। ৯০ ডেসিবেল মাত্রার কাছাকাছি শব্দ শ্রবণ অতিরিক্ত শব্দের মধ্যে দীর্ঘদিন কাটালে শ্রবণশক্তি ধীরে ধীরে কমে যাওয়া এমনকি বধির হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর অতিরিক্ত শব্দের কারণে কানের নার্ভ ও রিসেপ্টর সেলগুলো নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মানুষ শ্রবণশক্তি হারাতে থাকে। কত ডেসিবেল শব্দে কতটুকু সময় কাটানো হচ্ছে তার ওপর বিষয়টি নির্ভর করে। ১২০ ডেসিবেল বা তার বেশি মাত্রার শব্দ সঙ্গে সঙ্গেই কানের পর্দা ফেটে কান নষ্ট করে দিতে পারে। প্রতিদিন ২ ঘণ্টা করে ৮৫ ডেসিবেল শব্দ যদি কোনো ব্যক্তির কানে প্রবেশ করে তাহলে ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি নষ্ট হবে। মানুষ সাধারণত ৩০-৪০ ডেসিবেল শব্দে কথা বলে। ৭০ ডেসিবেল পর্যন্ত মানুষের কান গ্রহণ করতে পারে। ৮০-এর ওপরে গেলেই ক্ষতি শুরু হয়। কাজেই আমরা আশা করব সবাই মিলে শব্দদূষণ রোধ করে শব্দ সচেতনতায় সোচ্চার হবো।