মধু কবির দেশপ্রেম
প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আব্দুস সালাম
সময়ের বাঁকে বাঁকে বিশ্বের বিভিন্ন জনপদে ক্ষণজন্মা যেসব মনীষীদের জন্ম হয় তাদের মধ্যে কবি-সাহিত্যিকরা অন্যতম, যারা লিখন শিল্পের মাধ্যমে মানব মনে ঠাঁই করে নেন। তারা নিজেদের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেন। সমাজ, দেশ ও জাতি গঠনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। সমাজের কুটিলতা, মলিনতা ও জরাজীর্ণতাকে পরিহার করে মানব সমাজের জন্য উপযুক্ত শান্তির নীড় বিনির্মাণই যাদের একমাত্র ব্রত। এই সাধনার পথকে ভালোবেসেই অনেকে আমৃতু্য সংগ্রাম করেন, নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন। তারা সাহিত্যের আকাশে ধ্রম্নব নক্ষত্রের মতো আলো ছড়ান। যাদের আলোয় আলোকিত হয়ে অনেকে নিজের জীবনকে শুধরে নেন। তাদের সংস্পর্শে বিশুদ্ধ মানুষ হওয়ার বাসনা মানব মনকে তাড়া করে প্রতিনিয়ত। তিনি বাংলা নব জাগরণের কালজয়ী স্রষ্টা ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ এবং বাংলা কবিতার প্রথম বিদ্রোহী কবি। এ রকমই একজন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবন ছিল বিচিত্র। তিনি ১৮৬২ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান। কিন্তু সেখানের আবহাওয়া এবং বর্ণবাদিতার কারণে বেশিদিন ইংল্যান্ডে থাকেননি। সেখান থেকে ১৮৬৩ সালে তিনি ফ্রান্সে পাড়ি দেন। ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে অবস্থানকালে তিনি ইতালীয় কবি পেত্রার্কের সান্নিধ্য পান। পেত্রার্কের রচিত সনেট মধু কবিকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। অবশেষে কবি বাংলা সনেটের দিগন্ত উন্মোচন করেন। বাংলা সাহিত্যে সনেট বা অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। কবি বাংলা সনেটকে নাম দেন চতুর্দশপদী কবিতা। কবির রচিত চতুর্দশপদী কবিতাগুলো ১৮৬৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কবিতার বিষয় ভাবনা ও পরিবেশন শৈলী মার্জিত ও পরিশীলিত। পৃথিবীর সব দেশে সবকালে প্রকৃত ভালো লেখকরা তার সাহিত্যের মধ্যে স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধের চেতনাকে ধারণ করে থাকেন। মধু কবি তার ব্যতিক্রম নন। প্রবাস জীবনে রচিত কবিতায় তার গভীর দেশপ্রেম ফুটে ওঠে। 'কপোতাক্ষ নদ' কবিতা তার অন্যতম উদাহরণ। এ নদের জলকে গভর্ধারিণী জননীর দুধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আবেগে আপস্নুত হয়ে কবি এভাবেই মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। 'সতত, হে নদ তুমি পড় মোর মনে/সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।/সতত যেমনি লোক নিশার স্বপনে/শোনে মায়া যন্ত্রধ্বনি তব কলকলে/জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে।/বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে/কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে/দুগ্ধ স্রোতরূপি তুমি মাতৃভূমিস্থানে।'
বঙ্গভাষা কবিতায় তিনি বলেন- হে বঙ্গ, ভান্ডারে তব বিবিধ রতন;/তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,/পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ/পরদেশে, ভিক্ষা বৃত্তি কুক্ষণে আচরি পালিলাম আজ্ঞা সুখে; পাইলাম কালে/মাতৃভাষা-রূপে খনি, পূর্ণ মণিজালে।
বঙ্গভূমির প্রতি কবিতায় কবি বলেন, 'রেখো, মা, দাসেরে মনে, এ মিনতি করি পদে' এখানে কবি বঙ্গভূমিকে 'মা' সম্বোধন করে মায়ের চরণে মিনতি করে বলেছেন, বঙ্গভূমি যেন তাঁর দাস সম পুত্র তথা কবিকে মনে রাখেন। অপর চরণে কবি বলেছেন, 'সাধিতে মনের সাধ, ঘটে যদি পরমাদ, মধুহীন ক'রো না গো তব মনঃকোকনদে' বঙ্গভূমির মন কবির কাছে পদ্মফুলের মতো। পদ্মফুলের মধ্যে যেমন মধু থাকে ঠিক তেমনিভাবে মধুকবি ও বঙ্গভূমির মনের মধ্যে বসবাস করার ইচ্ছা পোষণ করেছেন।
মৃতু্যর কিছুদিন আগেও মধুকবি লিখেছেন-
'দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব/ বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে।'
কবি সাহিত্যের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবোধ সুউচ্চে সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কবির স্বদেশ চেতনা ও জাতীয়তাবোধের এক অনন্য বৈশিষ্ট্যেও আত্মপরিচয় পাওয়া যায়। মধুকবি রচিত চতুর্দশপদী কবিতাগুলো শুধু সাহিত্য ভান্ডারকেই সমৃদ্ধ করেননি; তিনি দান করেছেন অভূত পূর্ব মর্যাদা ও সৌন্দর্য। অনন্য স্বকীয় বৈশিষ্ট্যেও কারণে তিনি আজ অবধি পাঠক হৃদয়ে সাদরে সমাসীন। তার সাহিত্য কর্মগুলো যুগ যুগ ধরে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।