সনেট কবি মাইকেল মধুসূদন
দুর্বিষহ শেষ জীবন
বাংলার এই মহান কবির শেষজীবন অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে কেটেছে। ঋণের দায়, অর্থাভাব, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা ইত্যাদির কারণে তার জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। শেষজীবনে তিনি উত্তরপাড়ার জমিদারদের লাইব্রেরি ঘরে বসবাস করতেন। স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃতু্যর তিনদিন পরে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন বাংলার এই মহাকবি কপর্দকহীন অবস্থায় জেনারেল হাসপাতালে মৃতু্যবরণ করেন এবং তাকে কলকাতার সার্কুলার রোডে সমাধি দেওয়া হয়...
প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
খোন্দকার শাহিদুল হক
যার প্রতিভা আশ্রয় করে বাংলাভাষা নতুনরূপে মূর্ত হয়ে ওঠে এবং সাহিত্যে নতুন যুগের সৃষ্টি হয় সেই মৌলিক প্রতিভাসম্পন্ন মহাকবি, নাট্যকার, বাংলা ভাষার সনেটের প্রবর্তক, অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদীর তীরে কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ও মাতা জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান। তার পিতা কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের একজন খ্যাতনামা উকিল ছিলেন। ফলে তিনি সাত বছর বয়সেই পিতার কাছে যান এবং খিদিরপুর স্কুলে দু'বছর পড়ার পর ১৮৩৩ সালে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন।
হিন্দু কলেজে পড়ার সময় মাইকেলের সাক্ষাৎ হয় ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসনের সঙ্গে। তিনি ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, পরে অবশ্য অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। এই মানুষটি প্রথম মাইকেলকে পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক তৈরি করেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন তার রোমান্টিক কবিতার ক্লাস মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য সাহিত্যের যশ খ্যাতি সম্পর্কে অবগত করেছিলেন মধুসূদনকে। রিচার্ডসন নিজে কবিতা লিখতেন এবং মধুসূদনকেও উৎসাহিত করতেন লেখালেখির ব্যাপারে। তখন থেকেই মধুসূদনের মনে নিজেকে ইংরেজি সাহিত্যের দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয় এবং ইংরেজ ভাবধারায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে নিজের ধর্মকে বাধা মনে করেন। তিনি ভাবলেন নিজেকে পুরোদমে প্রতিষ্ঠা করতে হলে এবং ইংরেজি সাহিত্য নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে হলে তাকে খ্রিষ্টান হতে হবে। তারপর যেই চিন্তাভাবনা সেই কাজ। মধুসূদন দত্ত থেকে হয়ে গেলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কিন্তু পরক্ষণেই সবকিছুই হিতে বিপরীত হয়ে যায়। হিন্দুত্ব না থাকায় মধুসূদনের জন্য কলকাতার হিন্দু কলেজের দ্বার আজীবনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে তিনি যেখানেই গেছেন বিড়ম্বনা তার পিছু ছাড়েনি।
এছাড়া ধর্মান্তরিত হওয়ার পর থেকেই তিনি তার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তার পিতাও এক সময় অর্থ পাঠানো বন্ধ করে দেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে কাছের মানুষও আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে থাকে। অপরদিকে যাদের সহযোগিতা পাওয়ার বাসনা নিয়ে তিনি ধর্মান্তরিত হওয়ার পথ বেছে নিয়েছিলেন তাদের দিক থেকেও তেমন সাড়া পাননি। ফলে মনের ভেতরে তিনি চরমভাবে একাকিত্ববোধ করতেন। তথাপি শত বিপর্যয়ের মধ্যেও তিনি কখনো সাহিত্যচর্চা ছাড়েননি।
পরবর্তী সময়ে তিনিই উনিশ শতকের বাঙালি নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃত শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি, নাট্যকার ও প্রহসন হয়ে ওঠেন। তিনি সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরতান রীতিকে পাশ কাটিয়ে নতুন রীতি প্রবর্তনের ফলে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি হিসেবেও আখ্যায়িত হন। তার কৃতিত্ব এখানেই যে, তিনি যা কিছু রচনা করেছেন তাতেই নতুনত্ব এনেছেন। তিনিই প্রথম পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ বাংলা সাহিত্যে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেছেন। তার অসাধারণ প্রতিভা আর দক্ষতা গুণে তখনকার বাংলা সাহিত্যে রচনাশৈলী ও বিষয় ভাবনাগত যে আড়ষ্ঠতা ছিল তা দূরীভূত হয়। তিনি ১৮৬০ সালে গ্রিক পুরান থেকে কাহিনি নিয়ে পদ্মাবতী নাটক রচনা করেন। এই নাটকেই তিনি পরীক্ষামূলকভাবে ইংরেজি কাব্যের অনুকরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার এটাই প্রথম। ফলে তিনি বাংলা কাব্যকে ছন্দের বন্ধন থেকে মুক্তি দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি একই ধারায় রামায়নের কাহিনি নিয়ে তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি মেঘনাদবধ মৌলিক মহাকাব্য রচনা করেন। তার এই কাব্যে প্রকৃত সত্য সন্ধান ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন আজও তুলনাহীন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন মূলত বাংলা সাহিত্যের যুগপ্রবর্তক কবি। তিনি তার কাব্যের বিষয় সংগ্রহ করেছিলেন প্রধানত সংস্কৃত কাব্য থেকে, কিন্তু পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ অনুযায়ী সমকালীন ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির জীবনদর্শন ও রুচির উপযোগী করে তিনি তা কাব্যে রূপায়িত করেন এবং তার মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যে এক নবযুগের সূচনা হয়। মধুসূদন তার অনন্য সাধারণ প্রতিভার দ্বারা বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি আবিষ্কার করে এই ভাষা ও সাহিত্যের যে উৎকর্ষ সাধন করেন, এর ফলেই তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি 'মধুকবি' নামে পরিচিত।
কবির জীবনের আরও একটি উলেস্নখযোগ্য বিষয় হলো, তিনি ১৮৬৩ সালে প্যারিস হয়ে ভার্সাই নগরীতে গিয়ে সেখানে অবস্থানকালে ইতালীয় কবি পেত্রার্কের অনুকরণে বাংলায় সনেট লিখতে শুরু করেন। বাংলা ভাষায় এটিও এক বিস্ময়কর নতুন সৃষ্টি। এর আগে বাংলা ভাষায় সনেটের প্রচলন ছিল না। দ্বিতীয়ত ভার্সাই নগরীতে থেকেই তিনি যেন মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে নতুনভাবে এবং একান্ত আপনভাবে দেখতে ও বুঝতে পারেন, যার চমৎকার প্রকাশ ঘটেছে তার বঙ্গভাষা, কপোতাক্ষ নদ ইত্যাদি সনেটে।
কবির শেষ রচনা মায়াকানন নাটক। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত তার ১২টি গ্রন্থ এবং ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত পাঁচটি গ্রন্থ রয়েছে।
বাংলার এই মহান কবির শেষজীবন অত্যন্ত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে কেটেছে। ঋণের দায়, অর্থাভাব, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা ইত্যাদির কারণে তার জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। শেষজীবনে তিনি উত্তরপাড়ার জমিদারদের লাইব্রেরি ঘরে বসবাস করতেন। স্ত্রী হেনরিয়েটার মৃতু্যর তিনদিন পরে ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন বাংলার এই মহাকবি কপর্দকহীন অবস্থায় জেনারেল হাসপাতালে মৃতু্যবরণ করেন এবং তাকে কলকাতার সার্কুলার রোডে সমাধি দেওয়া হয়। মহাকবি জীবনের অন্তিম মুহূর্তেও অবিস্মরণীয় পংক্তিমালায় জন্মভূমির প্রতি তার সুগভীর ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন। তার সমাধিস্থলে নিচের কবিতটি লেখা রয়েছে।
\হ
'দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি
বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী'