শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৭ আশ্বিন ১৪৩১

কালোধোঁয়ার স্বাস্থ্যঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি শিশুরা

বায়ুদূষণের ফলে শিশুর মধ্যে অস্থিরতা, ঘুম কম হওয়া, খিটখিটে স্বভাব দেখা যেতে পারে। আমরা ইদানীং প্রায়ই লক্ষ্য করছি, শিশুদের মধ্যে ক্ষুদামন্দা ও বমি বমি ভাব খুব বেশি দেখা যায়। এছাড়া, পড়াশোনা অমনোযোগী বা পড়ার প্রতি অনীহা দেখা যায়। এর অন্যতম কারণ হলো বায়ূদূষণ
ডা. সামিনা আরিফ
  ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
কালোধোঁয়ার স্বাস্থ্যঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি শিশুরা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'শিশির বিন্দু' কবিতার কয়েকটি লাইনের সঙ্গে আমাদের প্রতিদিনের জীবনের মিল খুঁজে পাই। কবিতার লাইনগুলো 'দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশির বিন্দু' কারণ আমরা প্রতিদিন সকাল থেকে রাত্রি অবধি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইসু্য নিয়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে ছুটে চলেছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে ছোট ছোট কিছু পদক্ষেপই যথেষ্ট জটিল রোগসহ এমনকি মৃতু্যঝুঁকি থেকে আমাদের জীবন বাঁচতে। আমরা ভুলে গেছি ছোট বা অল্প সমস্যার সমাধান করতে। আধুনিকতার বড় বড় ইসু্য নিয়ে কাজ করতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমরা ভুলে যাই আমাদের জীবন বাঁচাতে ব্যক্তিগত সচেতনাই যথেষ্ট। ব্যক্তিগত সচেতনাই পারে আমাদের সুস্থ্য রাখতে। আমরা এই যান্ত্রিক জীবনে প্রতিনিয়ত জীবিকার তাগিদে ছুটে চলেছি। অনেক বড় বড় ইসু্য প্রতিদিন সামনে এসে দাঁড়ায় এবং জীবিকার তাগিদে ভুলে যাই আমাদের শরীর ও মনের যত্ন নিতে। একবারও কি চিন্তা করেছি ঘর থেকে বের হওয়ার পর থেকে আমরা বিভিন্ন রোগের এমনকি মৃতু্যর ঝুঁকিতে থাকি। আমরা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পাই সুন্দর সকালের শুভ্রতা ঘড়ির কাঁটার সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কালোধোঁয়ার কুয়াশায় ঢেকে যেতে থাকে আমাদের চারদিক। কিন্তু এই বিষয়ে কারো কোনো ভ্রূক্ষেপ পরিলক্ষিত হয় না। যার কারণে দিন দিন যানবাহনের কালোধোঁয়াসহ ধূমপায়ীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। আমরা বিশুদ্ধ অক্সিজেনের পরিবর্তে প্রতিনিয়ত পরিমাণের তুলনায় কার্বন ডাই-অক্সাইড বেশি গ্রহণ করছি। যানবহনের কালোধোঁয়ায় কার্বন-মনোক্সাইড (ঈঙ), কার্বন ডাই-অক্সাইড (ঈঙ২), ক্রোমিয়াম (ঈৎ), সিসা (চন), নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড (ঘ২ঙ ) ইত্যাদি ক্ষতিকর উপাদান থাকে। যার কারণে মানবদেহে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণসহ দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগ, ক্যানসার, হৃদরোগ, কিডনি ও মস্তিষ্কের নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। খুবই দুঃখের বিষয় হলো- যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার ফলে কি পরিমাণ বিষাক্ত ধোঁয়া যাত্রী, পথযাত্রী বা রাস্তার পাশে বসবাসরত জনগণ প্রতিনিয়ত গ্রহণ করছি তা আমাদের চিন্তারও বাহিরে।

এছাড়া লক্ষ্য করা যায়, উন্মুক্ত স্থানে ধূমপান শুধু যে ধূমপায়ীর জন্য ক্ষতিকর তা না। তার আশপাশে যারা থাকবে তারাও পরোক্ষভাবে ধূমপানের জন্য ক্ষতির শিকার হয়। সিগারেটের উপাদানগুলোতে নিকোটিন (ঈঙঐ১৪ঘ২), কার্বন ডাই-অক্সাইড (ঈঙ ২) এবং কার্বন-মনোঅক্সাইড (ঈঙ) থাকে।

বায়ুদূষণের ফলে শিশুর মধ্যে অস্থিরতা, ঘুম কম হওয়া, খিটখিটে স্বভাব দেখা যেতে পারে। আমরা ইদানীং প্রায়ই লক্ষ্য করছি, শিশুদের মধ্যে ক্ষুদামন্দা ও বমি বমি ভাব খুব বেশি দেখা যায়। এছাড়া, পড়াশোনা অমনোযোগী বা পড়ার প্রতি অনীহা দেখা যায়। আসলে একটু যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখা যায় শিশুরা স্কুল, কোচিং বা বাইরে বের হলে চোখে জ্বালাপোড়া, চোখ লাল হওয়া, বমি বমি ভাব বা এমনকি রাস্তায় বা যানবহনে তাদের বমি করতেও দেখা যায়- বিশেষ করে শিশুদের। তার অন্যতম কারণ হলো বায়ূদূষণ।

বায়ু দূষণের কারণে শিশুরা ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। যেমন- হাঁপানি, ব্রঙ্কিওলাইটিস, দীর্ঘস্থায়ী এমফাইসিমা, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিস, সর্দি, কাশি, অ্যাজমা, নিউমোনিয়াসহ ফুসফুসের ক্যানসার। বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের বুদ্ধির বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়।

এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ব্যাপক হারে ওজোন গ্যাস (ঙ৩)-এর উপস্থিতি রয়েছে- যা বায়ুদূষণজনিত রোগের অন্যতম কারণ। এক জরিপে দেখা যায়, কম বয়সি শিশুরা বায়ুদূষণজনিত রোগে বেশি শিকার হয়ে থাকে। আজকের শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আমরা যদি তাদের সুস্থ শরীর ও সুস্থ মন দিতে না পারি তাহলে আমরা কখনোই একটি সুন্দর জাতি আশা করতে পারি না। মনে রাখতে হবে আজকের শিশুরাই নেতৃত্ব দেবে আগামীর। তাই দূষণমুক্ত বাতাস গ্রহণ করা তার মৌলিক অধিকার। চালকের একটু সচেতনতাই পারে দূষণমুক্ত বাতাস নিশ্চিত করতে- কারণ যানবাহনের চালক নিশ্চিত করবে তার গাড়ি থেকে কালোধোঁয়া যেন নির্গত না হয়। তেমনি ধূমপায়ীরা কোনো জনসমাগমপূর্ণ বা পরিবহণে ধূমপান করবেন না। আপনাদের অসচেতনায় বা অসতর্কতায় আপনার আপন কেউ যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না তা কি বলতে পারেন? শাসন বা দন্ডে দন্ডিত করার চেয়ে আমরা নিজেরাই সচেতন হই। নিজেদের বিবেককে জাগ্রত করি।

এছাড়াও, শিশু-কিশোরদের রোগ প্রতিরোধ কম থাকায় বায়ুদূষণজনিত বিভিন্ন রোগের ঝুঁকিতে তারা বেশি থাকে। নবজাতক শিশুদের শ্বাসরোগেও বাতাসের বা সিগারেটের ধোঁয়ায় পরোক্ষভাবে নবজাতকের ফুসফুস বা বায়ু থলি চুপসে যায়। ফলে, শিশু শ্বাস নিতে পারে না নবজাতক শ্বাসকষ্ট, দ্রম্নত হৃৎস্পন্দন ও অক্সিজেনের অভাবে নীল হতে দেখা যায়। এছাড়াও, বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের বুদ্ধির বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়। তার মধ্যে ভুলে যাওয়া, অস্তিরতা, ঘুম কম হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, অল্পে রেগে যাওয়া, বিরক্ত হওয়া, পড়াশোনায় মনোযোগ না দিতে পারাসহ একাধিক শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। বর্তমানে শিশু -কিশোরীদের মধ্যে অউঐউ (অঃঃবহঃরড়হ ফবভরপরঃ/যুঢ়বৎধপঃরারঃু ফরংড়ৎফবৎ)-এর উপসর্গ বেশি দেখা যাচ্ছে। পূর্ণ বয়স্ক মানুষের বা বয়স্কদের মধ্যে চোখ জ্বালা করা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়া, কাশি, নিউমোনিয়া হতে দেখা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়েদের জন্য কতটা ভয়ংকর তা আমাদের ধারণাতেও নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় জনস্বাস্থ্য গবেষণা সংস্থা আইসিডিডিআর, বি'র একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা শহরে অপরিণত শিশু প্রসব এবং কম ওজন নিয়ে শিশু জন্ম নেওয়ার আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে। শিশু মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থাতেই ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। সারাজীবনের জন্য তা স্থায়ী হতে পারে। প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় শিশুরা তাদের ওজনের অনুপাতে বেশি বাতাস শ্বাস নেওয়ার সময় গ্রহণ করে। ফলে, ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়াসহ বিভিন্ন জীবাণু খুব সহজেই শিশুর শরীরে প্রবেশ করতে পারে। ফুসফুসের মধ্যে থাকা সারফেকট্যান্ট নামের তরল পদার্থ দূষিত বায়ুর প্রভাবে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে, শিশুদের শ্বাসকষ্টের সমস্যায় বেশি পড়তে দেখা যায়। যার ফলে, তাদের ফুসফুস, হৃৎপিন্ড, শরীর ও মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব পড়ে। বায়ুদূষণের ফলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। যানজট বাংলাদেশের একটি প্রধান সমস্যা- যার কারণে বাংলাদেশের মানুষ শারীরিক, মানসিক বা আর্থিকভাবে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গবেষকরা বলেন, দুটি সিগারেটে যে পরিমাণ নিকোটিন থাকে, তা সুস্থ মানুষের দেহে প্রবেশ করানো হলে তার তাৎক্ষণিক মৃতু্য ঘটবে। ধূমপায়ী শুধু নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হন না পরোক্ষভাবে তার আশপাশের অধুমপায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়াও এক গবেষণায় দেখা গেছে ধূমপানের পর চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা পরও তার শরীরে ধূমপানের বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ বিদ্যমান থাকে। যা তার আশপাশের মানুষসহ পরিবার ও সন্তানের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। বায়ুদূষণ অক্সিডেটিভ চাপ বাড়িয়ে মানুষের হৃৎপিন্ডের রক্তনালির ক্ষতি করে- যা পরে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, হার্ট-অ্যাটাক এবং হার্ট ফেলের কারণ হয়ে উঠতে পারে।

শিশুসহ পূর্ণ বয়স্ক মানুষের ফুসফুস, হৃৎপিন্ডসহ বিভিন্ন রোগ এমনকি মৃতু্যর ঝুঁকি কমাতে আমি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ পরিবেশ উপদেষ্টার কাছে বিনীতভাবে কিছু আবেদন বা পরামর্শ রাখতে চাই। আমাদের বায়ুদূষণ থেকে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এবং শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ওপর অতিশীঘ্র পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে আমি মনে করি।

১। যানবাহনের কালোধোঁয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচলের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা উচিত।

২। জনসমাগমপূর্ণ এলাকা বা মুক্ত পরিবেশে ধূমপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজন বোধে ধূমপান নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগ করার ব্যবস্থাগ্রহণ করা উচিত।

৩। রাস্তায়, খোলা পরিবেশে, হোটেলের সামনে, উন্মুক্ত পরিবেশে রান্না বা চুলা ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।

৪। ইটের ভাটা শহর থেকে দূরে এবং জনবসতি পূর্ণ এলাকার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরে স্থাপন করতে হবে।

৫। প্রতিটি রাস্তা, পরিত্যক্ত জমিতে এবং উদ্যানগুলোতে ফলজ, বনজ, ঔষধি গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থাৎ বনায়ন তৈরি করতে হবে।

৬। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে বায়ুদূষণ সম্পর্কে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, লিফলেট, পাঠ্যপুস্তুকের মাধ্যমে পরিবেশের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব বিষয়ে তাদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

ডা. সামিনা আরিফ

বিফার্ম (অনার্স), এমফার্ম, এমবিএ, ডিএইচএমএস

অধ্যক্ষ-কাম-অধীক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) ও সহযোগী অধ্যাপক।

ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজে ও হাসপাতাল

মোবা. ০১৭৫২-৫৭২২১৩, ইমেইল-ংধসরহধধৎরভ৭৪১@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে