নবজাতকের যত্ন : করণীয় ও বর্জনীয়
প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ নবজাতকের জন্য আদর্শ খাবার। এতে শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। জন্মের পর প্রথম ১ ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত- যা 'কলস্ট্রাম' নামে পরিচিত এবং এটি শিশুর ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
প্রকাশ | ০২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল (চিকিৎসক, কবি, ছড়াকার ও কলামিস্ট)
নবজাতকের আগমন পরিবারের জন্য এক অসাধারণ মুহূর্ত। একটি শিশুর জন্ম শুধু পরিবারের জন্য নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলে। তবে নবজাতকের যত্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয়, এ সময় শিশুদের স্বাস্থ্য, শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং সুরক্ষা নিয়ে বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া দরকার। নবজাতকের যত্নে কিছু বিশেষ নিয়ম ও সতর্কতা রয়েছে- যা মেনে চলা অত্যাবশ্যকীয়। সঠিক যত্ন না নিলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
নবজাতকের যত্নে যা করবেন
স্তন্যপান করান
প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধ নবজাতকের জন্য আদর্শ খাবার। এতে শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। জন্মের পর প্রথম ১ ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো উচিত- যা 'কলস্ট্রাম' নামে পরিচিত এবং এটি শিশুর ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
নিয়মিত ত্বকের যত্ন নিন
নবজাতকের ত্বক অত্যন্ত কোমল এবং স্পর্শকাতর। শিশুর ত্বককে ভালোভাবে পরিচ্ছন্ন রাখা গুরুত্বপূর্ণ। নবজাতককে নিয়মিতভাবে উষ্ণ পানি দিয়ে গোসল করান এবং শিশুদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি মৃদু সাবান ব্যবহার করুন। গোসলের পর ভালো মানের ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন যাতে ত্বক শুষ্ক না হয়।
নিয়মিত পটি পরিবর্তন করুন
নবজাতকরা দিনে বেশ কয়েকবার পটি করে, তাই ডায়াপার সময়মতো পরিবর্তন করা জরুরি। ডায়াপার দীর্ঘ সময় ধরে থাকলে ত্বকে সংক্রমণ হতে পারে। পটি পরিবর্তনের সময় শিশুর নিতম্ব পরিষ্কার রাখতে মৃদু বেবি ওয়াইপস বা কাপড় ব্যবহার করুন এবং শুকিয়ে যাওয়ার পর ডায়াপার পরান।
ঘরে সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখুন
নবজাতকের শরীরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কম থাকে, তাই তার ঘরের তাপমাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। নবজাতকের জন্য ২০-২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উপযুক্ত। অতিরিক্ত শীত বা গরম যেন না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
নিয়মিত ও সময়মত ভ্যাকসিন দিন
নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত ভ্যাকসিনেশন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের নিয়মিত সঠিক সময়সূচি অনুযায়ী ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য নিকটস্থ স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।
পর্যাপ্ত ঘুমের ব্যবস্থা করুন
নবজাতক দিনে প্রায় ১৬-২০ ঘণ্টা ঘুমায়। পর্যাপ্ত ঘুম তার শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিশুর জন্য একটি নিরাপদ ও আরামদায়ক ঘুমের পরিবেশ তৈরি করা উচিত। নবজাতককে সমতল ও সুরক্ষিত স্থানে রাখুন এবং তার ঘুমের সময় পরিবেশ শান্ত রাখার চেষ্টা করুন।
স্নেহ এবং ভালোবাসা দিন
শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য স্নেহ এবং ভালোবাসা অপরিহার্য। নবজাতকের সঙ্গে নিয়মিত শারীরিক স্পর্শ এবং মমতা প্রদর্শন করলে সে মানসিকভাবে নিরাপত্তার অনুভূতি পায় এবং ভবিষ্যতে তার আবেগীয় বিকাশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
নবজাতকের মানসিক যত্ন
নবজাতকের শারীরিক যত্নের পাশাপাশি মানসিক যত্নও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর মানসিক বিকাশে সঠিক যত্ন এবং পরিবেশ প্রয়োজন।
শিশুর সাথে কথা বলুন
শিশুদের বয়স অনুযায়ী ভাষার বিকাশ ঘটে এবং তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। নবজাতক যদিও কথা বলতে পারে না, তবে সে তার আশপাশের শব্দ এবং সুর শুনে ভাষার ধারণা তৈরি করতে থাকে। তাই তার সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা উচিত, এতে সে দ্রম্নত কথা বলা শেখে এবং মানসিক বিকাশও ভালো হয়।
শিশুকে খেলাধুলার সুযোগ দিন
নবজাতক শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকলে তার মানসিক বিকাশও দ্রম্নত ঘটে। সঠিক খেলনা বা ছোটখাটো খেলাধুলার মাধ্যমে তার ইন্দ্রিয় এবং মানসিক বিকাশকে উৎসাহিত করুন। শিশুর বয়স অনুযায়ী খেলনা নির্বাচন করুন এবং তার সুরক্ষার দিকে নজর রাখুন।
পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান
নবজাতক পরিবারের সান্নিধ্যে থেকে মানসিকভাবে স্বস্তি পায়। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে শিশুর সময় কাটানোর সুযোগ দিন। এতে তার সামাজিক বিকাশও ভালো হবে এবং সে মানসিকভাবে নিরাপত্তার অনুভূতি পাবে।
নবজাতকের যত্নে যা করবেন না
কৃত্রিম দুধ বা খাবার দেবেন না
প্রথম ছয় মাস শুধু মায়ের বুকের দুধই নবজাতকের জন্য সেরা খাদ্য। কৃত্রিম দুধ, মধু, পানি বা অন্য কোনো খাবার শিশুকে দেওয়া উচিত নয়। মায়ের দুধে সমস্ত পুষ্টি এবং পানির চাহিদা পূরণ হয়, তাই শিশুকে বাড়তি কিছু খাওয়ানো দরকার নেই।
জোরপূর্বক ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করবেন না
প্রত্যেক নবজাতক তার নিজস্ব রুটিন অনুযায়ী ঘুমায় এবং জেগে ওঠে। শিশুকে জোর করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করলে তা তার ঘুমের অভ্যাসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। শিশুকে নিজের মতো করে ঘুমাতে দিন এবং তার ঘুমের সময়ে যতটা সম্ভব শান্ত পরিবেশ নিশ্চিত করুন।
শিশুকে একা ঘরে রাখবেন না
নবজাতককে কখনোই দীর্ঘ সময়ের জন্য একা রেখে যাওয়া উচিত নয়, বিশেষ করে ঘুমের সময়। এটি শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। শিশুকে সব সময় নজরের মধ্যে রাখুন এবং প্রয়োজন হলে কোনো সাহায্যকারীকে দায়িত্ব দিন।
অতিরিক্ত গোসল করাবেন না
নবজাতককে প্রতিদিন গোসল করানোর প্রয়োজন নেই, কারণ অতিরিক্ত গোসল তার ত্বক শুষ্ক করে তুলতে পারে। সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার গোসল করানোই যথেষ্ট। এছাড়া প্রতিদিন তার মুখ, হাত-পা এবং নিতম্ব পরিষ্কার করা উচিত।
ধুলোময় বা দূষিত পরিবেশে রাখবেন না
শিশুকে এমন পরিবেশে রাখা উচিত যেখানে ফ্রেশ বাতাস এবং পরিষ্কার পরিবেশ রয়েছে। দূষিত বা ধুলোময় পরিবেশ নবজাতকের ফুসফুসের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এবং শ্বাসকষ্ট বা অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। ধূমপান থেকেও নবজাতককে দূরে রাখতে হবে।
অতিরিক্ত মানুষকে কোলে নিতে দেবেন না
নবজাতকের শরীর অত্যন্ত নাজুক, তাই তাকে বারবার ভিন্ন ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া উচিত নয়। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে এবং শিশুর স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে নবজাতকের মুখে স্পর্শ করা বা তাকে চুম্বন করা উচিত নয়।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া শিশুকে ওষুধ দেবেন না
কোনো রকম শারীরিক সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া শিশুকে ওষুধ দেওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। অনেক সময় সাধারণ ঠান্ডা বা হালকা জ্বর হলে অভিভাবকরা নিজেরাই ওষুধ দিয়ে থাকেন- যা শিশুদের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ দেওয়া একেবারেই ঠিক নয়।
নবজাতকের যত্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি একটি সংবেদনশীল প্রক্রিয়া। সঠিকভাবে যত্ন নেওয়া হলে শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ সুষ্ঠু হয়। উপরে বর্ণিত যত্নের নিয়মগুলো মেনে চললে নবজাতকের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে এবং ভবিষ্যতে সে একজন সুস্থ, সবল এবং মানসিকভাবে পরিপক্ব মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।