বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের ভয়াবহতা আমরা দেখেছিলাম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে মৃতু্যবরণ করেন ৮৬৮ জন। ওই সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় প্রায় ২ লাখ ৪৩ হাজার ৭৪৮ জন। ২০২৩ সালেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যবরণ করেন ১ হাজার ৭০৫ জন। ২৩ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যত মানুষ মৃতু্যবরণ করেন তার মধ্যে ২০২৩ সালেই প্রায় দ্বিগুণ মানুষের মৃতু্য হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা ২০২৪ সালে ডেঙ্গু রোগের ভয়াবহতা আরো বাড়তে পারে। এখন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে মৃতু্য সংখ্যাও বাড়ছে।
আমরা জানি, ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত ৩ ধরনের হতে পারে ১। ডেঙ্গু ক্লাসিক্যাল ফিভার ২। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ৩। ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ফিভার। ১। ডেঙ্গু ক্লাসিক্যাল ফিভারের উপসর্গ দেখা দিলে সাধারণত সংক্রমণের ৩ থেকে ১৪ দিন পর শুরু হয়। উচ্চ জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশি ও জয়েন্টে ব্যথা, ত্বকের একটি বৈশিষ্ট্যযুক্ত চুলকানি এবং ত্বকে ফুসকুড়ি থাকতে পারে। ২। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের উপসর্গগুলোর মাঝে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং শরীরে ফুসকুড়ি। দুই থেকে সাত দিনের মাঝে সাধারণত ডেঙ্গু রোগী আরোগ্য লাভ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি মারাত্মক রক্তক্ষয়ী রূপ নিতে পারে- যাকে ডেঙ্গু রক্তক্ষয়ী জ্বর বা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়। ৩। ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ফিভারের উপসর্গগুলোর মধ্যে অন্যতম উপসর্গ শরীরে ব্যথা সঙ্গে তীব্র মাথার যন্ত্রণা, মাংসপেশি এবং অস্থিসন্ধিতে (নড়হব) যন্ত্রণা, গ্রন্থি ফুলে যাওয়া, চোখের পেছনে ব্যথা হতে পারে। সঙ্গে চামড়ায় লালচে দাগ থাকতে পারে।
ছোট একটি ছিদ্র ডুবিয়ে দিতে পারে একটি জাহাজ, তেমনি প্রায় ৫ মিলি সাইজের ডেঙ্গু মশা কেড়ে নিতে পারে একটি জীবন। ডেঙ্গু জ্বর যাদের হয়েছে তারাই একমাত্র জানেন এই মশার লক্ষণের ভয়াবহতার রূপ। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছিল ছোট ডেঙ্গু মশার কাছে আমি এতটাই অসহায় ছিলাম যে, কিছুই করার ছিল না। সেই সঙ্গে অনেক রোগীর রক্তের পস্নাটিলেটের সংখ্যা কমতে থাকে। তখন বিচলিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় উত্তম। কোনোক্রমেই তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি জ্বর হলে তা উপেক্ষা না করে রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। শুধু রোগীই নয়, সেই সঙ্গে পরিবার পরিজনরা প্রতিটি মুহূর্তে আতঙ্কিত থাকেন। কারণ রোগী থাকেন জীবন মৃতু্যর সন্ধিক্ষণে। শিশু, অতি বয়স্ক, হৃদরোগী, কিডনি রোগে আক্রান্ত এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ডেঙ্গুর জটিলতার ঝুঁকি বেশি দেখা যায়। ডেঙ্গু রোগীদের কোনোরকম ওষুধ রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাওয়ানো উচিত নয়। সেই সঙ্গে প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম নেওয়া।
শিশুরা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয় বেশি এবং জটিলতাও বেশি দেখা যায়। শিশুদের ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ এ জ্বরের তাপমাত্রা ১০১ থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট থাকতে পারে। ডেঙ্গু হলেই যে তীব্র জ্বর হবে তা নয়। ২. শিশুর মধ্যে স্বাভাবিক চঞ্চলতা থাকবে না। শিশু নিস্তেজ হয়ে যেতে পারে ও অযথা কান্নাকাটি করতে পারে। ৩. শিশুর মধ্যে প্রচন্ড ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়। ৪. বমি বমি ভাব বা কিছু খেলেই বমি দেখা দেয়। ৫. শিশুদের ৬-৮ ঘণ্টা প্রস্রাব না হওয়া ডেঙ্গুর মারাত্মক লক্ষণগুলোর মধ্যে একটি। ৬. শারীরে লালচের্ যাশ দেখা দিতে পারে। ৭. মাথাব্যথা ও শরীর ব্যথা এবং পেটে ব্যথা হতে পারে। ৮. পাতলা পায়খানা বা পানি শূন্যতা দেখে পারে। ৯. চোখ লালচে হয়ে যেতে পারে। ১০. পরিস্থিতি গুরুতর হলে অর্থাৎ ডেঙ্গুর কারণে শিশুর শকে যাওয়ার অবস্থা হলে তার পেট ফুলে যেতে পারে বা শরীরে বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যেমন- রক্তবমি বা পায়খানার সঙ্গে বমি হওয়া। শিশুদের ক্ষেত্রে দেরি না করে অতি সত্বর হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো ভাবেই সময়ক্ষেপণ করা যাবে না।
বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু হলে রোগীকে স্বাভাবিক সব ধরনের নরম খাবার খেতে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে বাড়িতে ফল থেকে তৈরি করা জুস, সু্যপ, ডাবের পানি, ওরস্যালাইন বা অন্যান্য তরল খাবার প্রচুর পরিমাণে দেয়া যেতে পারে। এগুলো শরীরের পানি এবং ইলেক্টোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে। বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের কমলা, ডালিম, ডাবের পানি, পেপে পাতার জুস, হলুদ, মেথি, ব্রকলি, পালংশাক, কিউইফল ইত্যাদি খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
যে সব খাবার ডেঙ্গু রোগীদের না দেয়া ভালো তা হলো- ১. তৈলাক্ত ও ভাজা খাবার ২. মসলাযুক্ত খাবার ৩. ক্যাফিনযুক্ত পানীয় ইত্যাদি।
বর্তমানে তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত এবং আদ্রর্তা হঠাৎ করেই পরিবর্তিত হয়েছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত অনেকাংশে দায়ী। হাইজিন এর প্রতি অসচেতনতা ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির জন্য অন্যতম কারণ বলে আমি মনে করি। এডিসের ঘনত্ব বেড়ে গেলে তখন ব্যবস্থা নিলে খুব বেশি কার্যকর হবে না। এডিস মশার লার্ভা সাধারণত স্থায়ী ও পরিষ্কার পানিতে বেশি বিস্তার লাভ করে। এছাড়াও স্রোতহীন পানি যেমন- ঝোপঝাড় যুক্ত নালা, ভাঙা পাত্রে জমে থাকা পানি ডেঙ্গু মশার প্রজননস্থল ইত্যাদি। তাছাড়া জমে থাকা বৃষ্টির পানি, ফেলে দেওয়া পস্নাস্টিকের ব্যাগ, টিনের কৌটা, ডাবের খোসা, পস্নাস্টিকের বোতলসহ অনেক কিছুতেই বংশ বিস্তার করতে পারে। তবে এডিস মশার লার্ভা ধ্বংস করতে এর উৎসস্থলে প্রাকৃতিক কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। পানিতে তেলের একটি পাতলা আবরণ দেওয়া হলে মশার লার্ভা দ্রম্নত মারা যায়। প্রাকৃতিক কিছু তেল যেমন- অলিভ অয়েল (ঈঐ৩(ঈঐ২)৭ঈঐ=ঈঐ(ঈঐ২)৭ঈঙঙঐ), ভেজিটেবল অয়েল ও কেরোসিন তেল (ঈ১২ঐ১৫), অ্যাপেল সিডার, ভিনেগার (ঈঐ৩ঈঙঙঐ), সাবান, বিস্নচিং পাউডার ঈধ(ঙঈও)২ সহ রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। অবশ্যই তা কীটতত্ত্ববিদদের পরামর্শক্রমে সীমানা ও কার্যকরী উপাদানের পরিমাণ নির্ধারণক্রমে নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে কোনোক্রমেই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়া বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য বা কীটনাশক নদী, খাল, বিল, ডোবা, জলাশয়, মাটিতে দেয়া যাবে না। মাটি বা প্রাণীর ক্ষতির কারণ হয় সেদিকে বিশেষ সর্তক থাকতে হবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি হাইজিন-এ আমরা বর্তমানেও অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের মধ্যে অধিৎবহবংং-এর খুব অভাব থাকায় স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিগুলোতে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে পাড়া, মহলস্নার শিক্ষিত জনগোষ্ঠীসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাইজিন, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ নিয়ে কাজ করা উচিত। ডেঙ্গু মোকাবিলায় চবৎংড়হধষ যুমরবহব, ঊহারৎড়হসবহঃধষ যুমরবহব এবং ঈড়সসঁহরঃু যুমরবহব-এর বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষ প্রশিক্ষণসহ কর্মসূচি প্রদানের নির্দেশ দিতে হবে; তেমনি ডেঙ্গু প্রতিরোধে হাইজিন বিষয়ে কাজ করলে অবশ্যই আমরা ডেঙ্গু ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাব। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসহ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক সেমিনার, ক্যাম্প বা লিফলেট বিতরণ করতে হবে। এছাড়া হাইজিন বিষয়ে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিগুলো প্রচারণাসহ প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখতে হবে। যেমন: ১. খেলার মাঠ ও ভবনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। ২. মাঠ বা ভবনে জমে থাকা পানি দ্রম্নত সরিয়ে ফেলতে হবে। ৩. সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য যে সব ফুলের টব রাখা হয়েছে সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। ৪. এডিস মশার প্রজনন স্থলে যাতে পানি জমতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। ৫. সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকরা ডেঙ্গু প্রতিরোধের বিষয়ে প্রত্যহ শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেবেন। ৬. রুটিন মাফিক কার্যকরী কীটনাশক স্কুল, কলেজ, পাড়া, মহলস্নাসহ উদ্যানে ছিটানোর উদ্যোগ নিতে হবে। ৭. জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে শহর এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুর জন্য আলাদা বেডের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ৮. পর্যাপ্ত স্যালাইন ও ওষুধের ব্যবস্থা করতে হবে। ৯. ডাক্তার ও নার্সদের ডেঙ্গুর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ১০. স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে ডেঙ্গু টেস্টের ব্যবস্থা করতে হবে। ১১. বাসার আঙিনাসহ চারিপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ১২. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অভিযান পরিচালনার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটসহ জনবল নিয়োগের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ১৩. কার্যকর কীটনাশক আমাদানির বা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। ১৪. বিত্তবানদের মশারি বিতরণের জন্য আহ্বান করতে হবে। ১৫. ডোবা, নালা, গর্ত থাকলে ভরাট করাতে হবে। ১৬. অধিৎবহবংং বাড়ানোর জন্য ব্যানার, লিফলেট বিলি করতে হবে। ১৭. পরিস্থিতি মোকাবিলায় কর্মকৌশল প্রণয়ন করা প্রয়োজন। ১৮. ফুল হাতা, ঢিলে ঢালা পোশাক পরিধান করতে হবে। ১৯. স্প্রে বা মশার কয়েল ব্যবহার করতে হবে (অবশ্যই ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা গ্রহণ করতে হবে)। ২০. বাড়ির ভেতরে, আশপাশে, অফিসে, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, হাসপাতাল ও রাস্তায় হাইজিন মেনে চলার সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সেবার মান উন্নয়ন প্রচারণার ওপর অনেক নির্ভর করে তাই আমাদের জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমগুলো চালিয়ে যেতে হবে। এই ক্ষেত্রে সব শ্রেণিপেশার মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তাই আমাদের প্রচারণার জন্য যেমন ১. দর্শনযোগ্য প্রজেক্টর বোর্ড ইত্যাদি। ২. চলচ্চিত্র, নাটিকা, কার্টুন ইত্যাদি। ৩. ইন্টারনেট, প্রেজেন্টেশন ইত্যাদি কর্মসূচি বিশেষভাবে নেওয়া প্রয়োজন। এছাড়াও লেকচার, ডেমোনেস্ট্রেশন, দলবদ্ধ আলোচনা, প্যানেল আলোচনা, সিম্পোজিয়াম, কর্মশালার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটি পরিবেশ প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, উন্নত পরিবেশ গড়ার জন্য একটি সুস্থ সুন্দর মনের প্রয়োজন। আসুন আমরা সবাই মিলে একটি সুস্থ ও সুন্দর ডেঙ্গুমুক্ত পরিবেশ গড়ি।
\হ
ডা. সামিনা আরিফ
বি.ফার্ম (অনার্স), এম. ফার্ম, এমবিএ, ডি.এইচ.এম.এস
অধ্যক্ষ-কাম-অধীক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) ও সহযোগী অধ্যাপক, ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
মোবা: ০১৭৫২-৫৭২২১৩
ইমেইল- ংধসরহধধৎরভ৭৪১@মসধরষ.পড়স