স্তন ক্যানসার ও করণীয়
প্রকাশ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
নাজিয়া আফরিন স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ নারী মৈত্রী
স্তন ক্যানসার এমন একটি রোগ, যেখানে স্তনের কোষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায় ও টিউমার তৈরি হয়। পরবর্তী সময় টিউমারগুলো সারা শরীরে ছড়িয়ে যায় ও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। স্তন ক্যানসার কোষ দুধ উৎপাদনকারী লোবিউলের ভেতরে শুরু হয়।
ক্যানসার গবেষণাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএআরসির হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৩ হাজারের বেশি নারী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় ছয় হাজারেরও বেশি। নারী ক্যানসার রোগীদের মধ্যে ১৯ শতাংশ স্তন ক্যানসারে ভোগেন। নারী-পুরুষ মিলিয়ে এর হার ৮.৩ শতাংশ।
স্তন ক্যানসারের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে মহিলারা, কারণ প্রায় ৯৯% স্তন ক্যানসার মহিলাদের মধ্যেই ঘটে এবং ০.৫-১% পুরুষদের মধ্যে ঘটে।
কেন হয়
বয়স বৃদ্ধি, স্থুলতা, অ্যালকোহলের ক্ষতিকর ব্যবহার, স্তন ক্যানসারের পারিবারিক ইতিহাস, বিকিরণ এক্সপোজারের ইতিহাস, প্রজনন ইতিহাস (যেমন যে বয়স থেকে মাসিক শুরু হয়েছিল এবং প্রথম গর্ভাবস্থার বয়স), তামাক ব্যবহার এবং পোস্ট মেনোপজাল হরমোন থেরাপি। আনুমানিক অর্ধেক স্তন ক্যানসার এমন মহিলাদের মধ্যে বিকাশ লাভ করে, যাদের লিঙ্গ (মহিলা) এবং বয়স (৪০ বছরের বেশি)।
উপসর্গ
স্তন ক্যানসার যখন প্রাথমিক অবস্থায় থাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো উপসর্গ দেখা যায় না, তাই প্রাথমিক শনাক্তকরণ করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্তন ক্যানসারের লক্ষণগুলোর মধ্যে-
দ্ব স্তনে পিন্ড বা ঘনভাব (প্রায়ই ব্যথা ছাড়া)
দ্ব স্তনের আকার বা আকৃতির পরিবর্তন।
দ্ব চাকাভাব, লালভাব, শক্ত বা স্তনের ত্বকে অন্যান্য পরিবর্তন।
দ্ব স্তনবৃন্তের (এরিওলা-কালো অংশ) চারপাশের ত্বকের পরিবর্তন।
দ্ব স্তনবৃন্তে অস্বাভাবিক কিছু হওয়া, রক্তাক্ত বা তরল জাতীয় কিছু বের হওয়া।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্যানসার কোষগুলো ফুসফুস, লিভার, মস্তিষ্ক এবং হাড়সহ অন্যান্য অঙ্গে খুব দ্রম্নত ছড়িয়ে যায়। একবার ছড়িয়ে গেলে, হাড়ের ব্যথা বা মাথাব্যথার মতো নতুন ক্যানসার-সম্পর্কিত উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সাধারণত ক্যানসারের চিকিৎসায় হরমোন থেরাপি, কেমোথেরাপি বা টার্গেটেড জৈবিক থেরাপিসহ ক্যানসারের কোষগুলোকে মেরে ফেলা এবং বিস্তার রোধ করার ওষুধের প্রয়োগ ঘটানো। এ ছাড়া সার্জারির মাধ্যমেও ক্যানসারযুক্ত (টিউমারের চারপাশে স্বাভাবিক টিসু্যর একটি ছোট রিম অপসারণ করা যাকে লাম্পেক্টমি বলা হয়) বা পুরো স্তন (মাস্টেক্টমি) অপসারণ করা হয়।
ক্যানসার চিকিৎসার সময় স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ
ক্যানসার সার্জারির পর, কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন গ্রহণ করার পর বা অন্য যে কোনো স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার পর সুষম খাবার ও শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রদান করে ও শক্তিশালী থাকতে সাহায্য করে, এমন খাবার গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে নমনীয়, কম মসলাযুক্ত, স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করা ভালো।
প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় প্রচুর ফল ও শাকসবজি থাকতে হবে। পর্যাপ্ত ক্যালরি এবং প্রোটিন থাকতে হবে।
স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে নিম্নোক্ত খাবার উপকারী:
হলুদ : মসলা হিসেবে বহুল প্রচলিত খাদ্য উপাদান হচ্ছে হলুদ। এতে আছে ক্যানসার প্রতিরোধী উপাদান। হলুদে স্তন, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল, ফুসফুস এবং ত্বকের ক্যানসার প্রতিরোধী গুণ রয়েছে।
রসুন: রসুনে রয়েছে অ্যালিয়াম নামক ক্যানসার প্রতিরোধী উপাদান। রসুনের গুণাগুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না। যে কোনোরকম টিউমারের বেড়ে ওঠাকে কমিয়ে আনে রসুন। স্তন ক্যানসার ছাড়াও কোলোরেক্টাল এবং প্রোস্টেট ক্যানসারের জন্য দারুণ উপকারী রসুন।
বাদামজাতীয় খাবার: বাদামে রয়েছে সেলেনিয়াম, ফাইবার এবং সাইটোকেমিক্যাল। টিউমার বেড়ে গেলে তার বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। প্রতিদিন এক মুঠো বাদামই যথেষ্ট।
গাঢ় সবুজ পাতাবহুল শাক: বাঁধাকপি, পালং শাকসহ যে কোনো গাঢ় সবুজ রঙের শাক দেহে পুষ্টি ও খনিজ জোগায়। ফাইবার, ভিটামিন বি, সাইটোকেমিক্যাল, ক্লোরোফিলসহ আছে আরও অনেক রকম স্তন ক্যানসার প্রতিরোধী ক্ষমতাম্পন্ন উপাদান।
আনার: আনার স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এর পলিফেনোলে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ক্যানসারের বেড়ে ওঠাকে থামায়। প্রতিদিন খেলে উপকার পাওয়া যায়।
ফুলকপি, ব্রোকলি: ফুলকপি, ব্রোকলিতে থাকা সালফোরোফেন এবং ইন্ডোলস উপাদানগুলো অস্বাভাবিক কোষের বর্ধন প্রতিরোধ করে। স্তন, বস্নাডার, লিম্ফোমা, প্রোস্টেট এবং লাং ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সামুদ্রিক মাছ বা স্যামন মাছ: সামুদ্রিক মাছ বা স্যামন মাছে রয়েছে ওমেগা-৩এস এবং ভিটামিন বি১২ ও ডি-এর উৎস। বিশেষ কিছু ভিটামিন বি ১২ ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করে। সিদ্ধ, রান্না বা পুড়িয়ে খেলেই উপকার মিলবে। এর সঙ্গে রসুন ও সবুজ শাক যোগ করলে অধিক ফল পাওয়া যায়।
মরিচ : যে কোনো মরিচে আছে সাইটোকেমিক্যাল এবং পুষ্টি উপাদান। মরিচ ক্যানসারের বৃদ্ধি ঠেকাতে কাজ করে। সবুজ মরিচ ক্লোরোফিলসমৃদ্ধ হওয়ায় অন্ত্রের ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদানের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। লাল মরিচে থাকে ক্যাপসাইসিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যারোটিনয়েড। এসবই স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে কাজ করে থাকে।
গ্রিন টি : নিয়মিত গ্রিন টি গ্রহণ করলে স্তন ক্যানসার থেকে ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায়। এই চায়ের সাইটোকেমিক্যাল স্তন ক্যানসার থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। প্রতিদিন এক কাপ গ্রিন টি স্বাস্থ্যের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ।
তিসি : তিসির বিচি বা তেল খুবই উপকারী। এতে রয়েছে ওমেগা-৩ এস, লিগনাস এবং ফাইবার। এগুলো ক্যানসার কোষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করে। দইয়ের সঙ্গে তিসি মিশিয়ে অধিক পুষ্টি যোগ করা যায়।
এ ছাড়া ওয়ালনাট, বেরি জাতীয় ফল, শস্যদানা, ডাল ও বিচিজাতীয় খাবারে রয়েছে স্তন ক্যানসার প্রতিরোধী উপাদান। অ্যালকোহল, সিগারেট, প্রক্রিয়াজাত কার্বোহাইড্রেট, নিম্নমাত্রার ফ্যাট এবং নিম্নমাত্রার কার্বোহাইড্রেট ও স্ন্যাক্স এড়িয়ে চলতে হবে।
নাজিয়া আফরিন
স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ
নারী মৈত্রী