বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১

টাক : কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

স্ট্রেস চুল পড়ার কারণগুলোর একটি। নিয়মিত ব্যায়াম, যোগব্যায়াম এবং মেডিটেশন মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রামও গুরুত্বপূর্ণ। যদি মানসিক চাপ খুব বেশি হয়, তবে কাউন্সেলিং বা থেরাপি নেওয়া যেতে পারে।
ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল (চিকিৎসক, কবি, ছড়াকার ও কলামিস্ট)
  ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
টাক : কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা

টাক বা চুল পড়া (অ্যালোপেসিয়া) একটি সাধারণ সমস্যা- যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এটি পুরুষ, নারী এবং শিশুদের সবাইকে প্রভাবিত করতে পারে। টাক পড়া বা চুল পড়ার প্রক্রিয়া, এর কারণ, ধরন এবং চিকিৎসা নিয়ে আজকের আয়োজন। টাকের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে- যা বিভিন্ন কারণ এবং লক্ষণ দ্বারা চিহ্নিত করা যায়।

অ্যান্ড্রোজেনেটিক অ্যালোপেসিয়া : এটি সবচেয়ে সাধারণ ধরনের টাক- যা পুরুষ এবং নারী উভয়েরই হতে পারে। এটি জেনেটিক এবং হরমোনজনিত কারণে হয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে সাধারণত চুলের রেখা পেছানো এবং মাথার উপরিভাগে চুল পড়া দেখা যায়। একে 'পুরুষালী টাক' বলা হয়। নারীদের ক্ষেত্রে মাথার সামনের এবং উপরের অংশের চুল পাতলা হয়ে যায়। একে 'নারী-ধরন টাক' বলা হয়।

অ্যালোপেসিয়া এরিয়াটা : এটি একটি অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভুলভাবে চুলের ফলিকলগুলিকে আক্রমণ করে এবং এর ফলে চুল পড়ে যায়। মাথার ত্বক বা শরীরের অন্যান্য স্থানে গোলাকার বা অসমান আকৃতির ছোট ছোট চুল পড়ার এলাকা দেখা যায়।

টেলোজেন এফ্লুভিয়াম : এটি একটি সাময়িক চুল পড়ার অবস্থা- যা সাধারণত শারীরিক বা মানসিক চাপ, হরমোন পরিবর্তন বা অন্য কোনো শারীরিক অসুস্থতার কারণে ঘটে। পুরো মাথার ত্বকজুড়ে চুল পাতলা হয়ে যায় এবং চুলের ঘনত্ব কমে যায়।

ট্র্যাকশন অ্যালোপেসিয়া : এটি চুলের ফলিকলগুলির উপর দীর্ঘদিন ধরে টান বা চাপ দেওয়ার কারণে ঘটে- যা সাধারণত নির্দিষ্ট ধরনের চুল বাঁধার পদ্ধতির ফলে হয়। সাধারণত চুলের রেখা এবং নির্দিষ্ট এলাকা থেকে চুল পড়ে বা ভেঙে যায়।

সিকারট্রিশিয়াল বা দাগযুক্ত অ্যালোপেসিয়া : এটি একটি বিরল ধরনের টাক, যেখানে চুলের ফলিকল ধ্বংস হয়ে যায় এবং সেখানে চিরস্থায়ী দাগ সৃষ্টি হয়। এ ধরনের অ্যালোপেসিয়ার কারণ প্রদাহজনিত রোগ, যেমন লুপাস, স্‌েক্লরোডার্মা ইত্যাদি। চুল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার ত্বকে দাগ, জ্বালা বা পোড়ার অনুভূতি হতে পারে। একবার ফলিকল ধ্বংস হয়ে গেলে সেই স্থানে আর চুল গজায় না।

অ্যানাজেন এফ্লুভিয়াম : এটি চুলের বৃদ্ধি পর্যায়ে ঘটে এবং সাধারণত কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন বা বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে আসার ফলে হয়। এক্ষেত্রে দ্রম্নত এবং ব্যাপকভাবে চুল পড়ে।

অ্যালোপেসিয়া টোটালিস এবং অ্যালোপেসিয়া ইউনিভার্সালিস : অ্যালোপেসিয়া টোটালিস এ পুরো মাথার ত্বক থেকে চুল পড়ে যায়। এর কারণ অটোইমিউন ডিজঅর্ডার, যেখানে ইমিউন সিস্টেম পুরো মাথার চুলের ফলিকলকে আক্রমণ করে। অ্যালোপেসিয়া ইউনিভার্সালিস এ পুরো শরীরের চুল পড়ে যায়- যার মধ্যে মাথার ত্বক, ভ্রূ, চোখের পাতা এবং শরীরের অন্যান্য অংশের চুল অন্তর্ভুক্ত। এর কারণ অটোইমিউন ডিজঅর্ডার, যেখানে শরীরের ইমিউন সিস্টেম পুরো শরীরের চুলের ফলিকলকে আক্রমণ করে।

ট্রাইকোটিলোম্যানিয়া : এটি একটি মানসিক সমস্যা, যেখানে ব্যক্তি নিজের চুল নিজেই টেনে ছিঁড়ে ফেলেন। টানা বা ছেঁড়ার কারণে নির্দিষ্ট স্থানে চুল পড়ে যায় বা চুল পাতলা হয়ে যায়। সাধারণত মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা অভ্যাসগত কারণে হয়।

ইনভোলিউশনাল অ্যালোপেসিয়া : এটি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে চুলের ঘনত্ব কমে যাওয়ার প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। চুল ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে যায় এবং মাথার ত্বক দেখা যেতে থাকে। এটি একটি প্রাকৃতিক বার্ধক্য প্রক্রিয়া, যেখানে চুলের ফলিকল ধীরে ধীরে বিশ্রাম পর্যায়ে প্রবেশ করে এবং নতুন চুলের বৃদ্ধি কমে যায়।

সেবোরিক ডার্মাটাইটিস : এটি একটি চর্মরোগ যা মাথার ত্বকে ফ্লেকিং এবং স্ক্যালিং সৃষ্টি করে- যা চুল পড়ার অন্যতম কারণ। অতিরিক্ত তেল উৎপাদন, ফাঙ্গাল সংক্রমণ বা ইমিউন সিস্টেমের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার কারণে মাথার ত্বকে চুলকানি, ফ্লেকিং, লালচে বা হলুদাভ চামড়ায় দেখা যায় এবং চুল পড়ে পাতলা হয়ে যায়।

টাক বা চুল পড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। তবে টাকের ধরন এবং কারণ অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ভিন্ন হয়।

সঠিক খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা : চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পুষ্টিকর খাদ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত প্রোটিন, আয়রন, জিঙ্ক এবং বায়োটিন সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। মাংস, ডিম, মাছ, ডাল, বাদাম থেকে প্রোটিন, লাল মাংস, পালংশাক, ব্রকলি, লেন্টিল থেকে আয়রন, সি-ফুড, দই, কুমড়ার বীজ জিঙ্ক, ডিম, এবং বিভিন্ন শাকসবজিতে বায়োটিন পাওয়া যায়।

সঠিকভাবে চুলের যত্ন : নিয়মিত এবং সঠিক পদ্ধতিতে চুল ধোয়া গুরুত্বপূর্ণ। ভালো মানের শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হবে- যা চুল ও মাথার ত্বকের জন্য উপযোগী। টাইট পনিটেল, ব্রেইডস বা অন্য কোনো স্টাইল- যা চুলের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে তা এড়িয়ে চলা উচিত। চুলে বিস্নচিং, স্ট্রেইটেনিং বা অতিরিক্ত হেয়ার ডাই ব্যবহার কমাতে হবে। এই ধরনের প্রসেসিং চুলের ক্ষতি করে।

মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ : স্ট্রেস চুল পড়ার প্রধান কারণগুলোর একটি। নিয়মিত ব্যায়াম, যোগব্যায়াম এবং মেডিটেশন মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রামও গুরুত্বপূর্ণ। যদি মানসিক চাপ খুব বেশি হয়, তবে কাউন্সেলিং বা থেরাপি নেওয়া যেতে পারে।

জীবনযাত্রায় পরিবর্তন : পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম চুলের স্বাস্থ্য রক্ষা করতে সহায়ক। শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে প্রচুর পানি পান করতে হবে- যা চুলের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। চুলে হিট স্টাইলিং (যেমন, হেয়ার ড্রায়ার, স্ট্রেইটেনার) থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ অতিরিক্ত তাপ চুলের ক্ষতি করতে পারে।

চুল প্রতিস্থাপন সার্জারি : এটি একটি সার্জিক্যাল পদ্ধতি, যেখানে শরীরের অন্যান্য অংশ থেকে সুস্থ চুলের ফলিকল নিয়ে টাকের স্থানে প্রতিস্থাপন করা হয়। এটি দীর্ঘ মেয়াদি ফলাফলের জন্য কার্যকরী হতে পারে।

চিকিৎসকের পরামর্শ : চুল পড়া শুরু হলে বা চুল পাতলা হয়ে গেলে, প্রথমেই একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। তিনি সঠিক কারণ নির্ণয় এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নির্ধারণ করতে পারবেন।

প্রাকৃতিক এবং ঘরোয়া পদ্ধতি : অ্যালোভেরা জেল মাথার ত্বকে প্রয়োগ করলে তা চুলের বৃদ্ধি বাড়াতে এবং মাথার ত্বকের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে। নিয়মিত নারকেল তেল ম্যাসাজ চুলের ফলিকলকে মজবুত করতে এবং চুল পড়া কমাতে সহায়তা করে। আমলকী এবং রিঠার প্যাক চুলের বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিক উপায় হিসেবে কয়েক যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

টাক নিয়ন্ত্রণে এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হলে অনেক ক্ষেত্রে চুল পড়া নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে এবং চুলের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হতে পারে। তবে, যদি চুল পড়া গুরুতর হয় বা কোনো নির্দিষ্ট কারণের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে