সাদাস্রাব: নারী জননাঙ্গের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া

বিভিন্ন সংস্কৃতিতে সাদাস্রাব নিয়ে ভুল ধারণা বা কুসংস্কার প্রচলিত আছে- যা নারীদের মধ্যে অযথা উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে। তাই, সাদাস্রাবের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং নারীদের সঠিক তথ্য প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি।

প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল
সাদাস্রাব বা লিউকোরিয়া নারীদের জননাঙ্গ থেকে নির্গত একটি সাদা বা হালকা হলুদ রঙের তরল- যা প্রায়শই একটি স্বাভাবিক এবং স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। এটি সাধারণত গর্ভাশয়, সার্ভিক্স এবং যোনি থেকে নিঃসৃত স্রাবের মাধ্যমে তৈরি হয় এবং নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য রক্ষা করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সাদাস্রাবের উপস্থিতি এবং প্রকৃতি বিভিন্ন কারণের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে- যা নারীর বয়স, হরমোনের পরিবর্তন, এবং প্রজনন চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। সাদাস্রাব মূলত যোনি বা জরায়ুর প্রাকৃতিক পরিচ্ছন্নতার প্রক্রিয়া। এটি প্রজনন অঙ্গের সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি স্বাভাবিক। যোনি নিজের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে সাদাস্রাব নির্গত করে। এটি যোনিপথের অভ্যন্তরীণ কোষের পুনর্গঠন ও মৃত কোষের অপসারণে সাহায্য করে। মাসিক চক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে, বিশেষ করে ওভুলেশনের সময়, সাদাস্রাবের পরিমাণ এবং গঠন পরিবর্তিত হতে পারে। এটি প্রজনন ক্ষমতার লক্ষণ হিসেবেও বিবেচিত হয়। গর্ভাবস্থায় হরমোনের পরিবর্তনের কারণে সাদাস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এটি জরায়ুর মিউকাস পস্নাগ গঠনেও সহায়ক হয়- যা গর্ভস্থ শিশুকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। যৌবনকালে এবং মেনোপজের সময় হরমোনের ওঠানামার কারণে সাদাস্রাবের প্রকৃতি ও পরিমাণে পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। যোনিতে প্রাকৃতিকভাবে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে সংক্রমণ হতে পারে- যার ফলে সাদাস্রাবের রং ও গন্ধ পরিবর্তিত হতে পারে। ক্যান্ডিডিয়া প্রজাতির ফাঙ্গাসের অতিরিক্ত বৃদ্ধি ইস্ট ইনফেকশনের কারণ হতে পারে- যা ঘন ও পনিরের মতো সাদাস্রাব সৃষ্টি করতে পারে। গনোরিয়া, ক্ল্যামিডিয়া ও ট্রাইকোমোনিয়াসিসের মতো যৌনবাহিত সংক্রমণও সাদাস্রাবের অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি করতে পারে। কিছু সাবান, ডিটারজেন্ট, স্যানিটারি পণ্য বা যোনি পরিষ্কার করার পণ্য যোনিতে অ্যালার্জি বা সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করতে পারে- যা সাদাস্রাবের কারণ হতে পারে। সঠিক পুষ্টির অভাব থাকলে এবং শরীরে ভিটামিন ও মিনারেলের ঘাটতি হলে সাদাস্রাবের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে। যোনির অপর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নতার ফলে ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাসের বৃদ্ধি হতে পারে- যা সংক্রমণ এবং সাদাস্রাবের কারণ হতে পারে। মানসিক এবং শারীরিক চাপ হরমোনাল পরিবর্তন ঘটায়- যা সাদাস্রাবের প্রকৃতি এবং পরিমাণে পরিবর্তন আনতে পারে। সাদাস্রাবের প্রকৃতি এবং পরিমাণ প্রাকৃতিকভাবে ভিন্ন হতে পারে, তবে এটি যদি অস্বাভাবিক বা অতিরিক্ত হয়, তাহলে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যোনি সব সময় পরিষ্কার এবং শুষ্ক রাখা উচিত। প্রতিদিন হালকা গরম পানি দিয়ে যোনি পরিষ্কার করা ভালো। বিশেষ ধরনের রাসায়নিকযুক্ত সাবান বা যোনি পরিষ্কার করার পণ্য ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন, কারণ এটি যোনির স্বাভাবিক ব্যাকটেরিয়া ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। পরিষ্কার ও সুতির অন্তর্বাস পরিধান করা উচিত। সুতির অন্তর্বাস বাতাস চলাচল করতে দেয় এবং আর্দ্রতা ধরে রাখে না, ফলে সংক্রমণের ঝুঁকি কম থাকে। মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড বা ট্যাম্পন নিয়মিত পরিবর্তন করা উচিত, যাতে জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো যায়। দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় পুষ্টিকর খাবার রাখা উচিত। সবুজ শাকসবজি, ফলমূল, দানাদার খাবার, প্রোটিন এবং পর্যাপ্ত পানি পান করা জরুরি। এই ধরনের খাবার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক হয়। দই, কেফির ও অন্যান্য প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার যোনির ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য রক্ষা করতে সহায়ক। যৌন সম্পর্কের সময় প্রয়োজনীয় সুরক্ষা নিশ্চিত করা উচিত। কনডম ব্যবহার করলে যৌনবাহিত সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সহবাসের পরে যোনি পরিষ্কার করা উচিত, যাতে সংক্রমণ এবং অন্যান্য সমস্যার ঝুঁকি কমে যায়। মানসিক চাপ হরমোনাল পরিবর্তনের মাধ্যমে সাদাস্রাবের পরিমাণ বাড়াতে পারে। তাই স্ট্রেস কমানোর জন্য মেডিটেশন, যোগব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুমের ব্যবস্থা করা উচিত। প্রতিদিন নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করা শরীরের সার্বিক সুস্থতার জন্য জরুরি- যা হরমোন ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। যদি সাদাস্রাবের প্রকৃতি বা পরিমাণ অস্বাভাবিক মনে হয়, যেমন গন্ধ, রং পরিবর্তন, বা যোনিপথে চুলকানি ও জ্বালা হয়, তাহলে দেরি না করে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে সাদাস্রাব নিয়ে ভুল ধারণা বা কুসংস্কার প্রচলিত আছে- যা নারীদের মধ্যে অযথা উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে। তাই, সাদাস্রাবের স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং নারীদের সঠিক তথ্য প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। সাদাস্রাব নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের একটি স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয় অংশ। এটি শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা, যা যোনি এবং প্রজনন পদ্ধতির সুস্থতা রক্ষা করে। স্বাভাবিক সাদাস্রাব সম্পর্কে সঠিক ধারণা এবং সচেতনতা নারীদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করতে এবং অস্বাভাবিক লক্ষণগুলো শনাক্ত করতে সহায়তা করবে- যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।