বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

সর্দি : অস্বস্তিকর স্বাস্থ্য সমস্যা

যদিও সর্দি খুব একটা ক্ষতিকারক অবস্থা সৃষ্টি করে না, তবে কিছু কিছু পরিস্থিতিতে এটি গুরুতর স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এবং অন্যান্য রোগের সূচনা বা জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাই সর্দি হলে যথাযথ বিশ্রাম, হাইড্রেশন এবং চিকিৎসা পরামর্শ গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যদি উপসর্গগুলো গুরুতর হয় বা দীর্ঘস্থায়ী হয়
ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা নীলফামারী সদর, নীলফামারী।
  ৩১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
সর্দি : অস্বস্তিকর স্বাস্থ্য সমস্যা

সর্দি সাধারণত একটি ভাইরাস সংক্রমণ, যা সাধারণত নাক এবং শ্বাসনালীর ওপরের অংশকে প্রভাবিত করে। এটি খুবই অস্বস্তিকর স্বাস্থ্য সমস্যা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য গুরুতর শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা যেমন ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়ার কারণ হতে পারে। সর্দি সাধারণত রাইনো ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট, তবে অন্যান্য ভাইরাস ও পরিবেশের বিভিন্ন এলারজিক ফ্যাক্টরও সর্দির জন্য দায়ী।

কারণ : সর্দির প্রধান প্রধান কারণগুলো :

\হ

ভাইরাস সংক্রমণ

সর্দির প্রধান কারণ হলো ভাইরাস সংক্রমণ, যেমন-

ঙ্ রাইনো ভাইরাস : সর্দির সবচেয়ে সাধারণ কারণ, যা সর্দির ৩০% থেকে ৫০% ক্ষেত্রে দায়ী। রাইনোভাইরাস সহজেই বাতাসে এবং সরাসরি স্পর্শের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

ঙ্ করোনা ভাইরাস : এই ভাইরাসগুলো সাধারণ সর্দির প্রায় ১০% থেকে ১৫% ক্ষেত্রে জড়িত।

ঙ্ অ্যাডিনো ভাইরাস : প্রায়শই শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটায় এবং সর্দি, গলা ব্যথা, বা চোখের প্রদাহ (কনজাঙ্কটিভাইটিস) সৃষ্টি করতে পারে।

ঙ্ প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস : সর্দির লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে। এটি শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ঘটাতে পারে যা সাধারণ সর্দির মতোই হয়।

ঙ্ রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস : প্রধানত শিশুদের মধ্যে সর্দি এবং গুরুতর শ্বাসযন্ত্রের সমস্যার কারণ হতে পারে। এটি সাধারণত শীতকাল এবং বসন্তে ছড়ায়।

ঙ্ হিউম্যান মেটানিউমো ভাইরাস :এটি একটি নতুনভাবে চিহ্নিত ভাইরাস যা সর্দি এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণ হতে পারে।

এলার্জি : ধূলিকণা, পরাগ, পশম, বা ছাঁচের মতো অ্যালার্জেন দ্বারা সৃষ্ট সর্দি।

ঠান্ডা আবহাওয়া এবং তাপমাত্রার পরিবর্তন

ঠান্ডা বা আকস্মিক তাপমাত্রার পরিবর্তন সর্দির ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলে। ঠান্ডা আবহাওয়া শ্বাসনালীর সুরক্ষামূলক বাধা দুর্বল করে দিতে পারে, যা ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও, শীতকালে মানুষ ঘরের ভেতরে বেশি সময় কাটায়, যা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ায়।

পরিবেশগত কারণ

বায়ু দূষণ : ধোঁয়া, রাসায়নিক বাষ্প এবং অন্যান্য বায়ুদূষক উপাদান শ্বাসযন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলে এবং সর্দির লক্ষণগুলোকে বাড়িয়ে তুলে।

এয়ার কন্ডিশনিং : শুষ্ক বাতাস এবং এয়ার কন্ডিশনিং শ্বাসনালীর শ্লেষ্মা ঝিলিস্ন শুষ্ক করে ফেলে, যা সর্দির লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে।

ধূমপান এবং ধোঁয়া

ধূমপান শ্বাসনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে, যা সর্দির ঝুঁকি বাড়ায়। ধোঁয়ার সংস্পর্শে আসা, এমনকি পরোক্ষ ধূমপান, শ্বাসনালীতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে।

মানসিক চাপ এবং জীবনযাত্রা

অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং অনিয়মিত জীবনযাপন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করতে পারে, যা সর্দির ঝুঁকি বাড়ায়। অপর্যাপ্ত ঘুম, অপুষ্টি এবং শরীরচর্চার অভাব সর্দির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

চিকিৎসাজনিত কারণ

কিছু কিছু চিকিৎসা অবস্থা, যেমন অ্যালার্জি, হাঁপানি, বা ইমিউন সিস্টেমের দুর্বলতা সর্দির ঝুঁকি বাড়ায়। ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হলে শরীর সহজেই ভাইরাস সংক্রমণের শিকার হতে পারে।

সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ

সর্দি সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শে আসলে বা তাদের স্পর্শ করা বস্তু স্পর্শ করলে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে ভাইরাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে।

হরমোনের প্রভাব

সর্দির সঙ্গে হরমোনের প্রভাবের সম্পর্ক সাধারণত সরাসরি নয়, তবে কিছু হরমোনীয় পরিবর্তন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং শ্বাসনালীতে প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া প্রভাবিত করতে পারে, যা সর্দির ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যেমন-

ঙ্ ইস্ট্রোজেন : এটি সাধারণত শরীরের ইমিউন প্রতিক্রিয়াকে বাড়িয়ে তোলে। তবে উচ্চ মাত্রায় ইস্ট্রোজেন শ্বাসনালীতে প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা সর্দির মতো উপসর্গের কারণ হতে পারে। মাসিক চক্রের কিছু নির্দিষ্ট পর্যায়ে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বাড়ে, যা নাক বন্ধ বা নাক দিয়ে পানি পড়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।

ঙ্ প্রজেস্টেরোন : গর্ভাবস্থার সময় প্রজেস্টেরোনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা শ্বাসনালীর মিউকাস ঝিলিস্ন ফোলাতে পারে এবং নাক বন্ধের কারণ হয়।

ঙ্ কর্টিসল : কর্টিসল হলো একটি স্টেরয়েড হরমোন যা শরীরে স্ট্রেসের প্রতিক্রিয়া হিসেবে উৎপন্ন হয়। উচ্চ মাত্রায় কর্টিসল ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে দেয় এবং ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ কর্টিসল স্তর বাড়িয়ে তোলে, যা সর্দির ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

ঙ্ থাইরয়েড হরমোন : থাইরয়েড হরমোন শরীরের মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণ করে এবং ইমিউন সিস্টেমেও প্রভাব ফেলে। থাইরয়েড গ্রন্থির অস্বাভাবিক কার্যকলাপ, যেমন হাইপারথাইরয়েডিজম বা হাইপোথাইরয়েডিজম, ইমিউন সিস্টেমের কার্যক্রম পরিবর্তন করতে পারে, যা সর্দির ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

ঙ্ মেলাটোনিন : মেলাটোনিন হরমোন, যা ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে, শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে। অনিদ্রা বা ঘুমের সমস্যা ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে দিতে পারে, যা সর্দির ঝুঁকি বাড়ায়।

ঙ্ অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি-ইমিউন হরমোন : কিছু হরমোন, যেমন গস্নুকোকর্টিকয়েড, প্রদাহ এবং ইমিউন প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। এই হরমোনগুলো প্রদাহ হ্রাস করতে সহায়ক হতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারে ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করতে পারে, যা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।

লক্ষণ ও উপসর্গ

ঙ্ নাক দিয়ে পানি পড়া বা বন্ধ নাক : সর্দির শুরুতে নাক দিয়ে পরিষ্কার তরল স্রাব হতে পারে যা কিছু দিন পর ঘন ও হলুদ বা সবুজ রঙ ধারণ করতে পারে। এছাড়া নাকের মিউকাস ঝিলিস্ন ফুলে যাওয়ার কারণে নাক বন্ধ হতে পারে, যা শ্বাস নিতে অসুবিধা সৃষ্টি করে।

ঙ্ হাঁচি : সর্দি থাকলে হাঁচি হওয়া খুব সাধারণ। এটি শরীরের ভাইরাস বা এলার্জেন অপসারণের একটি প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া।

ঙ্ গলা ব্যথা : ভাইরাস সংক্রমণ গলার মিউকাস ঝিলিস্নতে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা ব্যথা, খসখসে অনুভূতি বা গিলতে অসুবিধা সৃষ্টি করে।

ঙ্ কাশি : সর্দির কারণে শুষ্ক বা ভেজা কাশি হতে পারে। শুষ্ক কাশি সাধারণত গলা বা শ্বাসনালীতে জ্বালা সৃষ্টির কারণে হয় আর ভেজা কাশি মিউকাস বা ফ্লেমের কারণে হতে পারে।

ঙ্ মাথাব্যথা : সর্দির সময় মাথাব্যথা বা চাপ অনুভূত হতে পারে, যা সাধারণত নাকের সাইনাসের প্রদাহের কারণে হয়। নাক বন্ধ থাকলে সাইনাসের চাপ বেড়ে যেতে পারে, যা মাথাব্যথা সৃষ্টি করে।

ঙ্ শরীরের ব্যথা ও ক্লান্তি : সর্দির সঙ্গে সাধারণত হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার শরীর ব্যথা এবং ক্লান্তি অনুভূত হতে পারে। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রক্রিয়ার অংশ।

ঙ্ জ্বর : সর্দি থাকলে সাধারণত হালকা জ্বর হতে পারে, বিশেষ করে শিশুদের। জ্বর সাধারণত ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৭.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এর নিচে থাকে।

ঙ্ চোখে জল আসা : সর্দির কারণে চোখে জল আসা বা চোখের চারপাশে প্রদাহ হতে পারে। এটি সাধারণত অ্যালার্জির কারণে বা ভাইরাসের কারণে ঘটে।

ঙ্ খাদ্য বা গন্ধের প্রতি সংবেদনশীলতা হ্রাস : নাক বন্ধ বা নাক দিয়ে পানি পড়ার কারণে খাবারের স্বাদ বা গন্ধের সংবেদনশীলতা কমে যেতে পারে।

প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

সর্দি থেকে সম্পূর্ণরূপে বাঁচার কোনো সুনির্দিষ্ট উপায় নেই। তবে কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে :

ঙ্ হাত ধোয়া : নিয়মিত হাত ধোয়া ভাইরাসের বিস্তার রোধ করতে সাহায্য করে।

ঙ্ মুখ ঢেকে রাখা : হাঁচি বা কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা উচিত যাতে ভাইরাস কণার ছড়িয়ে পড়া রোধ করা যায়।

ঙ্ পর্যাপ্ত বিশ্রাম : রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী রাখতে সহায়ক।

ঙ্ হাইড্রেশন : প্রচুর পরিমাণে পানি পান করে শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা।

ঙ্ গলা গার্গল করা : উষ্ণ লবণ পানি দিয়ে গার্গল করলে গলা ব্যথা উপশম করতে পারে।

ঙ্ নেসাল স্প্রে বা ড্রপস : নাকের বন্ধ অবস্থায় স্বস্তি দিতে পারে।

ঙ্ ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ : ব্যথা, জ্বর এবং কাশির উপশমের জন্য ওষুধ সেবন করতে পারেন, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে নেওয়া উচিত।

সর্দির ক্ষতিকর প্রভাব

ঙ্ দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রভাব :সর্দি সাধারণত ক্লান্তি, অস্বস্তি এবং শারীরিক দুর্বলতা সৃষ্টি করে, যা দৈনন্দিন কাজের দক্ষতা এবং গুণমানকে প্রভাবিত করতে পারে।

ঙ্ ঘুমের সমস্যা : নাক বন্ধ এবং কাশি, সর্দিকালীন সময় ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, যা ক্লান্তি ও দুর্বলতা বৃদ্ধি করতে পারে।

ঙ্ প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া : কিছু ক্ষেত্রে, সর্দি থেকে জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেমন সাইনাসের সংক্রমণ, কানের সংক্রমণ, ফুসফুসের সংক্রমণ (ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া)।

ঙ্ ভাইরাসের বিস্তার : সর্দি অত্যন্ত সংক্রামক, যা সহজেই পরিবারের সদস্যদের, সহকর্মীদের বা অন্যান্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে, বিশেষ করে সংক্রমণের প্রাথমিক দিনগুলোতে।

ঙ্ হাঁপানি এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি : হাঁপানি বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজের মতো শ্বাসযন্ত্রের সমস্যাযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য সর্দি, লক্ষণগুলোকে আরও গুরুতর করতে পারে এবং অস্থায়ী শ্বাসকষ্টের কারণ হতে পারে।

যদিও সর্দি খুব একটা ক্ষতিকারক অবস্থা সৃষ্টি করে না, তবে কিছু কিছু পরিস্থিতিতে এটি গুরুতর স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এবং অন্যান্য রোগের সূচনা বা জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাই সর্দি হলে যথাযথ বিশ্রাম, হাইড্রেশন এবং চিকিৎসা পরামর্শ গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যদি উপসর্গগুলো গুরুতর হয় বা দীর্ঘস্থায়ী হয়। এছাড়াও, সর্দি থেকে সুরক্ষা পেতে হাত ধোয়া, সঠিকভাবে শ্বাস নেওয়া এবং সংক্রমিত ব্যক্তির থেকে দূরে থাকা জরুরি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে