শুক্রবার, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

নাক ডাকা : কারণ, প্রভাব ও সমাধানে করণীয়

বিকট শব্দে নাক ডাকলে পাশের বাড়ি বা ঘর থেকে তা শোনা যায়, যা সবার জন্য অস্বস্তিকর ও বিরক্তিকর। বাচ্চারা নাক ডাকলে তা সব সময়ই অস্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয় এবং এটি সাধারণত কোনো না কোনো রোগের কারণ হিসেবে মনে করা হয়।
ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, নীলফামারী সদর, নীলফামারী। (চিকিৎসক, কবি, ছড়াকার, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক)
  ২৬ জুন ২০২৪, ০০:০০
নাক ডাকা : কারণ, প্রভাব ও সমাধানে করণীয়

সব বয়সের জন্য নাক ডাকা একটি সাধারণ সমস্যা। সাধারণত নাক, তালু বা মুখগহ্বর হল নাক ডাকার শব্দের উৎপত্তিস্থল। এসব স্থানের কোথাও কোনো রোগ বা প্রদাহের কারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যায়। নাকের হাড় বাঁকা, সাইনাসে প্রদাহ এবং মোটা মানুষের ক্ষেত্রে গলার মধ্যে অতিরিক্ত মেদ জমা নাক ডাকার অন্যতম প্রধান কারণ। মাঝবয়সি ও বয়স্ক পুরুষের ক্ষেত্রে এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। বয়স চলিস্নশের উপরে গেলে অল্প শব্দে নাক ডাকা তেমন কোনো ক্ষতির কারণ নয়। তবে বিকট শব্দে নাক ডাকলে পাশের বাড়ি বা ঘর থেকে সেই শব্দ শোনা যায়- যা সবার জন্য অস্বস্তিকর ও অত্যন্ত বিরক্তিকর। বাচ্চারা নাক ডাকলে তা সব সময়ই অস্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয় এবং এটি সাধারণত কোনো না কোনো রোগের কারণ হিসেবে মনে করা হয়। এডিনয়েড গ্রন্থি বড় হয়ে গেলে, গ্রন্থিটির ঘনঘন ইনফেকশন, কোনো কারণে টনসিল বড় হয়ে গেলে অথবা উভয়ক্ষেত্রে সাধারণত এমনটি হয়ে থাকে। সবচেয়ে মারাত্মক হলো ঘুমের মধ্যে দমবন্ধ হয়ে শ্বাস নেওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করা, যাকে স্নোরিং ও স্স্নিপ এপনিয়া সিনড্রোম বলা হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি শ্বাসের রাস্তায় বাতাস চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে হয়ে থাকে, একে অবস্ট্রাক্টিভ স্স্নিপ এপনিয়া বলে। এ প্রতিবন্ধকতা নাসারন্ধ্র্র থেকে ফুসফুস পর্যন্ত যে কোনো স্থানে হতে পারে।

নাক ডাকার কারণসমূহ

শারীরিক গঠন: কিছু মানুষের শ্বাসনালির গঠন এমন হয়- যা নাক ডাকার প্রবণতা বাড়ায়। বিশেষ করে যদি গলার টিসু্যগুলো পুরু হয়।

অতিরিক্ত ওজন : শরীরের ওজন অতিরিক্ত হলে গলার চারপাশে অতিরিক্ত টিসু্য জমে- যা শ্বাসপ্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টি করে।

গলার পেশি শিথিল হলে : ঘুমের সময় গলার পেশিগুলো শিথিল হয়ে যায়- যা নাক ডাকার কারণ হতে পারে।

নাক ও শ্বাসনালির ভেতরে প্রতিবন্ধকতা: নাকের পলিপ, সাইনাসের সমস্যা, অথবা ঠান্ডা লাগলে শ্বাসনালিতে বাধা সৃষ্টি হয় যা নাক ডাকায়।

অ্যালার্জি : অ্যালার্জি থাকলে নাক বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং এর ফলে নাক ডাকতে পারে।

অ্যালকোহল ও সিডেটিভ জাতীয় ওষুধ : অ্যালকোহল এবং সিডেটিভ জাতীয় ওষুধ গলার পেশি শিথিল করে যা নাক ডাকার কারণ হতে পারে।

স্স্নিপ এপনিয়া : এটি একটি গুরুতর সমস্যা, যেখানে ঘুমের মধ্যে শ্বাসনালিতে বারবার বাধা সৃষ্টি হয়, যার ফলে, উচ্চ শব্দে নাক ডাকার ঘটনা ঘটে।

নাক ডাকার প্রভাব

নাক ডাকা কেবল একটি সাধারণ সমস্যা নয়, এটি কিছু কিছু গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণও হতে পারে। যেমন :

স্স্নিপ এপনিয়া

স্স্নিপ এপনিয়া একটি গুরুতর ঘুমের অসুখ যেখানে শ্বাস-প্রশ্বাসে বারবার বাধা সৃষ্টি হয়, যা ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে ঘটে। স্স্নিপ এপনিয়ার প্রধান লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে : উঁচু আওয়াজে নাক ডাকা, ঘুমের মধ্যে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া, ঘুমের মধ্যে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, ক্লান্তি ও দিনের বেলায় ঘুমঘুম ভাব।

উচ্চ রক্তচাপ

নাক ডাকার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের একটি সম্পর্ক থাকতে পারে বলে চিকিৎসাবিদরা মনে করেন। দীর্ঘমেয়াদি স্স্নিপ এপনিয়া ও সংশ্লিষ্ট ঘুমের সমস্যার কারণে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়তে পারে।

হৃদরোগ

গুরুতর নাক ডাকা এবং স্স্নিপ এপনিয়া হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এটি বিভিন্ন হৃদরোগ এমন কি হার্ট ফেইলিউরেরও কারণ হতে পারে।

টাইপ-২ ডায়াবেটিস

স্স্নিপ এপনিয়া এবং নাক ডাকার সঙ্গে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের সম্পর্ক আছে। ঘুমের সমস্যা ইনসুলিন প্রতিরোধের ঝুঁকি বাড়াতে পারে- যা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ।

মোটা হওয়া

অতিরিক্ত ওজন এবং নাক ডাকার মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

স্ট্রোক

গুরুতর স্স্নিপ এপনিয়া স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। স্স্নিপ এপনিয়া এবং নাক ডাকার কারণে রক্তপ্রবাহে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে- যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।

অবসাদ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা

নাক ডাকার কারণে অপর্যাপ্ত ঘুম এবং ক্লান্তি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে। এটি অবসাদ, উদ্বেগ ও অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়।

পারিবারিক সম্পর্কে প্রভাব

নাক ডাকা অনেক সময় ঘুমের সঙ্গীর জন্য বিরক্তির কারণ হতে পারে- যা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

নাক ডাকার সমস্যা সমাধানে করণীয়

জীবনধারা পরিবর্তন

ওজন কমানো : অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে শ্বাসনালির ওপর চাপ কমানো যায়- যা নাক ডাকার সম্ভাবনা হ্রাস করে।

ঘুমানোর ভঙ্গি পরিবর্তন : চিত হয়ে না শুয়ে পাশ ফিরে শোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

অ্যালকোহল এবং ধূমপান পরিহার : অ্যালকোহল এবং ধূমপান গলার পেশি শিথিল করে এবং শ্বাসনালির বাধা সৃষ্টি করে।

নাকের স্ট্রিপ এবং বাহ্যিক ডিভাইস

নাকের স্ট্রিপ : নাসাল স্ট্রিপ বা ডিলেটর ব্যবহার করে নাকের ভেতরে বায়ুপ্রবাহ বাড়ানো যায়।

মৌখিক যন্ত্র : ডেন্টাল ডিভাইস বা মৌখিক যন্ত্র ব্যবহার করে নিচের চোয়ালকে সামনের দিকে ধরে রাখা যায়- যা শ্বাসনালির বাধা কমায়।

ওষুধ এবং স্প্রে

নাসাল ডিকঞ্জেস্টেন্ট : ঠান্ডা বা অ্যালার্জি থেকে মুক্তি পেতে নাসাল ডিকঞ্জেস্টেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।

অ্যালার্জির ওষুধ : অ্যালার্জির জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ কার্যকর হতে পারে।

চিকিৎসাগত পদ্ধতি

সিপিএপি (ঈচঅচ) মেশিন : স্স্নিপ এপনিয়ার জন্য সিপিএপি মেশিন ব্যবহার করা হয়- যা একটি মুখোশের মাধ্যমে শ্বাসনালিতে অবিচ্ছিন্ন বায়ুপ্রবাহ সরবরাহ করে।

অপারেশন : কিছু ক্ষেত্রে সার্জারির মাধ্যমে গলার পেশি বা টিসু্য অপসারণ করা হয়- যা শ্বাসনালির বাধা কমায়।

স্স্নিপ পজিশন ট্রেনিং

স্স্নিপ পজিশনিং ডিভাইস : কিছু ডিভাইস রয়েছে যা চিত হয়ে শুতে বাধা দেয় এবং পাশ ফিরে শোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলে।

থেরাপি

টং থ্রাস্ট এক্সারসাইজ : কিছু ব্যায়াম রয়েছে- যা গলার পেশিকে শক্তিশালী করে এবং নাক ডাকার সমস্যা কমায়।

বিশেষজ্ঞ পরামর্শ

স্স্নিপ স্টাডি : যদি নাক ডাকার সমস্যা গুরুতর হয় এবং স্স্নিপ এপনিয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে স্স্নিপ স্টাডির মাধ্যমে বিস্তারিত পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

নাক ডাকা একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এটি কখনো কখনো স্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর সমস্যার কারণ হতে পারে। সচেতনতা ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নাক ডাকা কমানো সম্ভব। যদি এই সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয় বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়, তাহলে দ্রম্নত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ ও সচেতনতার মাধ্যমে নাক ডাকার সমস্যা এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো সম্ভব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে