শিশুর জন্মের প্রথম দিন থেকে ২৮তম দিন পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় নবজাতক অবস্থা। জন্মের সময় ও ওজনের তারতম্যের ওপর ভিত্তি করে এই নবজাতক শিশু আবার বিভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। যেমন: কেউ নির্দিষ্ট সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ হয়, কেউ সময়ের পরে জন্মলাভ করে। আবার কেউ বা ঠিক সময়েই জন্ম নেয়। কারো জন্ম-ওজন হয় স্বাভাবিক, কারো ওজন হয় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশি। হাসপাতালে নয়, আমাদের দেশের বেশিরভাগ শিশুর জন্ম হয় বাড়িতে, গ্রামে কেউ হাসপাতালে নিতে চান না। ৮০ শতাংশেরও বেশি শিশুর জন্ম হয় পেশাজীবী দাই কিংবা অন্য বয়স্ক সদস্য, যেমন: দাদি, নানি বা অন্য আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে। অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ফলে জন্মকালীন অনেক সমস্যা হয়। পরবর্তীকালে নবজাতকের যত্নও ঠিকমতো নেয়া হয় না। আবার এমন কিছু সামাজিক প্রথা আছে, যা চর্চার ফলে নবজাতকের জীবন বিপন্ন হতে পারে।
প্রচলিত সামাজিক রীতি ও কুসংস্কারসমূহ:
অনেকেই গর্ভকালে মাকে কম খেতে দেন। কেউ কেউ মায়ের পেটে নাভির ওপরে গামছা বা কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখেন, যাতে শিশু বড় না হয়। বড় শিশু ডেলিভারিতে সমস্যা হবে, এমনই ধারণা তাদের।
ম ডেলিভারির জন্য আলো-বাতাসহীন অন্ধকার ঘর ভালো, প্রদীপ কিংবা মোমবাতির আলো ব্যবহার করতে হবে, মাটির পাত্রে কয়লার আগুন মায়ের কাছে রাখতে হবে এমন প্রচলিত কুসংস্কারও রয়েছে অনেক এলাকায়।
ম ডেলিভারির পর নবজাতকের পা উপরে দিয়ে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে রেখে মুখে পানির ঝাপটা মারা, পিঠে চাপড় দেয়া, নাকে-মুখে-তালুতে ফুঁ দেওয়া এবং জন্মের সঙ্গে সঙ্গে গোসল করানো খুবই ভয়ংকর কুসংস্কার।
ম নাভি কাটার জন্য বাঁশের কঞ্চি বা জীবাণুমুক্ত নয় এমন বেস্নড ব্যবহার করা এবং নাভি কাটার পর নাভিতে ছাই, গোবর, হলুদ, পান খাওয়ার খয়ের, ঘি ইত্যাদি লাগানো হতে পারে। এসব শিশুর ইনফেকশন ও ধনুষ্টঙ্কারের বড় কারণ।
ম বুকের দুধ নিয়েও রয়েছে ভুল ধারণা। শালদুধ ফেলে দেওয়া বা দেরিতে বুকের দুধ খাওয়ানো। বুকের দুধ না দিয়ে মধু, মিছরির পানি, শরবত বা গস্নুকোজের পানি দেওয়া, কৌটার দুধ খাওয়ানো ইত্যাদি অন্যতম।
ম চোখ বা পায়ের নিচে কাজল, বিছানায়, গলায়, হাত-পায়ে দেশলাই, রসুন বা লোহার টুকরা রাখা, তাবিজ বেঁধে দেয়া, কালো সুতা বেঁধে রাখা ইত্যাদি তো আছেই।
এসব কুসংস্কারের কারণে আমাদের দেশে নবজাতকের মৃতু্যসহ নানারকম সমস্যা প্রায়ই দেখা যায়। সুশিক্ষা, জনসচেতনতা, শিশু জন্মের সময় হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা শিক্ষিত দাইয়ের শরণাপন্ন হওয়ার ব্যাপারে পরিবারের সবাইকে বিশেষ করে বাড়ির কর্তা ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধ করলে নবজাতকের মৃতু্যহার অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
নবজাতক শিশুর যত্নে কার্যকরী পদক্ষেপ:
ম প্রথম ও প্রাথমিক পরিচর্যা হলো নবজাতক বাচ্চাকে উষ্ণ রাখা। ভূমিষ্ঠ হয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাসে আসার পরপরই নবজাতক শিশুর দ্রম্নত ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। এটা তার জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে যেতে পারে, এমনকি মৃতু্যঝুঁকিও থাকে। কাজেই এদিকটা সবার আগে খেয়াল রাখতে হবে।
ম নবজাতক শিশু প্রস্রাব-পায়খানা করলে সঙ্গে সঙ্গে তার কাপড় পরিবর্তন করে দিতে হবে। ঠান্ডা-গরম আবহাওয়া বুঝে তার পোশাক নির্বাচন করতে হবে। শিশুদের ডায়াপার বা প্যামপারস পরানোতে কোনো সমস্যা নেই, বরং নবজাতক শিশুটি তাতে আরামেই থাকবে। এর ফলে, শিশুটির জামাকাপড় বা বিছানা ভিজে যাওয়ার এবং ঠান্ডা লাগার আশঙ্কাও কম থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে ডায়াপারের্ যাশ বা অ্যালার্জি হতে পারে।
ম প্রতি ঘণ্টায় শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে বা যখনই শিশুটি দুধ খেতে চাইবে তখনই তাকে চাহিদামতো বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত সে শুধু বুকের দুধই খাবে। প্রথম দুধটাকে 'শালদুধ' বলা হয়, যেটা নবজাতক শিশুর জন্য রোগ প্রতিরোধকারী প্রথম টিকা বলা হয়ে থাকে। তাই জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যেই বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য উপদেশ দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে, ছয় মাসের আগ পর্যন্ত কোনো কৌটার দুধ, মধু, মিছরির পানি বা খাবার পানি ইত্যাদি বাচ্চার মুখে দেওয়া ঠিক নয়।
ম জন্মের পরপরই সব নবজাতক শিশুর কমবেশি ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস হয়ে থাকে এবং সেটা সাধারণত দুই-তিন সপ্তাহ পর এমনিতেই সেরে যায়। এ জন্য নবজাতক শিশুকে দৈনিক আধাঘণ্টা সকালের রোদে রাখতে হবে তিন সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত। তাতে সে ভিটামিন 'ডি' পাবে এবং ভিটামিন 'ডি' ঘাটতিজনিত রোগ থেকে মুক্তি পাবে। পাশাপাশি তার জন্ডিসের প্রকোপটাও কমে আসবে। বাচ্চার ত্বক বেশি হলুদ মনে হলে, প্রস্রাব হলুদ রঙের হলে অবশ্যই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ম নবজাতককে জন্মের তিন দিন পর থেকে প্রতিদিন দুপুরে হালকা গরম পানি দিয়ে পুরো শরীর মোছাতে হবে এবং নাভি পড়ে না যাওয়া অবধি এ কাজটা অব্যাহত রাখতে হবে। এতে বাচ্চার ত্বক পরিষ্কার থাকবে এবং গায়ে কোনো ইনফেকশন বা অ্যালার্জি হবে না। যেদিন নাভি পড়ে যাবে, তার পরদিন থেকেই গোসল দেওয়া যেতে পারে।
ম নবজাতকের গায়ে তেল, সাবান, কাজল, লোশন, শ্যাম্পু, ভ্যাসলিন, ক্রিম, পাউডার ইত্যাদি কোনো কিছু লাগানো বা মাখানো উচিত নয়। তাতে নবজাতক শিশুটির গায়ে অ্যালার্জি বা স্কিন ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে।
ম জন্মের পরপরই লেবাররুমেই নবজাতকের নাভিতে ৭.১% ক্লোরহেক্সিডিন লাগানো হয়, যেটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত। এখন সর্বত্রই এই প্র্যাকটিস চলছে। এটাই নবজাতকের নাভির যত্নের জন্য যথেষ্ট, আর কিছু লাগানোর প্রয়োজন নেই।
ম নবজাতক শিশুকে ইনজেকশন 'ভিটামিন কে-ওয়ান' (২ মিগ্রা) মুখে খাওয়াতে হবে। সেটা জন্মের প্রথম দিন, চতুর্থ দিন ও ২৮তম দিনে। এটাও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত। এর ফলে, নবজাতক শিশুর রক্তক্ষরণজনিত সমস্যাগুলো দূর হবে, শিশুটি নিরাপদ থাকবে।
ম নবজাতকের দেড় মাস বয়স হলেই নিয়মিত টিকাদান শুরু করতে হবে। এই সময় থেকেই জীবনরক্ষাকারী ১০টি টিকা দেওয়া হয়। তবে এর আগেই শুধু বিসিজি বা যক্ষ্ণা প্রতিরোধকারী টিকা দিয়ে নেওয়া ভালো। সরকারিভাবে এই ১০টি টিকা ছাড়াও আরো কিছু টিকা রয়েছে, সেগুলো শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
ম নবজাতক বাচ্চার বয়স দুই সপ্তাহ পার হলেই রুটিন চেকআপ করিয়ে নেওয়া উত্তম। কারণ এই সময়টাতে নবজাতকের শরীরে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
ম কোনো কোনো নবজাতক শিশুর চোখে পিঁচুটি জমে বা পানি পড়ে। এটা স্বাভাবিক এবং সহজেই নিরাময়যোগ্য। শুধু পানি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করে দিতে হবে। এ ছাড়া কোনো কোনো মেয়ে নবজাতক শিশুর যৌনাঙ্গ দিয়ে সাদা বা লাল স্রাবের মতো তরল পদার্থ নিঃসরণ হতে দেখা যায়। এটা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। শুধু তার যৌনাঙ্গটা নিয়মিত পানি দিয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে। আবার কোনো কোনো বাচ্চা বেশিমাত্রায় মোচড়ানি দেয়, সেটাও স্বাভাবিক এবং সময়ের ব্যবধানে তা ঠিক হয়ে যায়।
ম অপরিপক্ক ও কম ওজনের বাচ্চা যদি জন্মগ্রহণ করে তাহলে সেই বাচ্চার প্রতি বেশি যত্নশীল হতে হবে। কম ওজন এবং সময়ের আগে যে বাচ্চা জন্মগ্রহণ করেছে তাদের ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ারে অর্থাৎ মায়ের বুকের সঙ্গে বাচ্চাকে একদম লাগিয়ে রাখতে হবে। কম ওজনের বাচ্চা হলে বাচ্চার ওজন আড়াই কেজি হওয়া পর্যন্ত ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার দিতে হবে। সারাদিনে ২০ ঘণ্টার বেশি ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্যেকবার বাচ্চাকে বুকে নেওয়ার পর টানা দুই ঘণ্টা রাখতে হবে। এই বিশেষ পদ্ধতিতে শিশুর যত্নে পরিবারের সবাইকে সহযোগী হতে হবে।
নবজাতকের যে কোনো ছোটখাটো সমস্যায় হেলাফেলা না করে দ্রম্নত নবজাতক বিশেষজ্ঞ বা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ বা নিকটস্থ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, নীলফামারী সদর, নীলফামারী।