সোরিয়াসিস এক ধরনের অসংক্রামক প্রদাহজনিত জটিল চর্মরোগ। এটি দীর্ঘমেয়াদি ত্বকের সমস্যা হিসেবে পরিচিত। এ রোগে ত্বক থেকে মাছের আঁশের মতো ত্বকের মৃতকোষ পেঁয়াজের শুকনো খোসার মতো উঠতে থাকে ও আক্রান্ত স্থান সাধারণত লাল হয়ে যায়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কোনো বয়সিরা এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে, তবে ত্রিশোর্ধ্বরাই বেশি আক্রান্ত হয়।
মানুষের ত্বকের কোষ প্রতিনিয়ত একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর নতুন করে তৈরি হয় এবং মরে ঝরে যায়। কিন্তু সোরিয়াসিসে আক্রান্ত কোষ বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিকভাবে হয়। সাধারণত ত্বকের সবচেয়ে গভীরের স্তর থেকে নতুন কেরাটিনোসাইট কোষ ওপরের স্তরে আসতে স্বাভাবিকভাবে কমপক্ষে ২৮ দিন সময় লাগে, আর সোরিয়াসিস হলে তা পাঁচ থেকে সাত দিনেই ঘটে থাকে। সোরিয়াসিস সাধারণত হাত, পা, পিঠ, ঘাড়, মাথার ত্বক, মুখসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানের ত্বকের হয়ে থাকে।
সোরিয়াসিসের কারণ:
এখন পর্যন্ত মূল কারণ জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, জেনেটিক ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে সোরিয়াসিস হয়ে থাকে। এছাড়া কিছু কিছু ফ্যাক্টরকেও কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়:
দ্ব দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা: ধারণা করা হয় সোরিয়াসিস হওয়ার একটি অন্যতম কারণ হলো অটো ইমিউনিটি। টি-কোষ নামে পরিচিত শ্বেত রক্তকণিকা ভুলবশত ত্বকের কোষকে আক্রমণ করে বসে।
দ্ব বংশগত কারণ: ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানা যায়, পরিবারের কারও সোরিয়াসিস থাকলে বা বংশে পূর্বে কেউ এ রোগে আক্রান্ত হলে বংশধরদের সোরিয়াসিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
দ্ব মানসিক চাপ: অস্বাভাবিক মানসিক চাপ সোরিয়াসিস বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
দ্ব অ্যালকোহল গ্রহণ: অ্যালকোহল ব্যবহারও সোরিয়াসিস বাড়িয়ে তুলতে পারে। অত্যাধিক মদ্যপান সোরিয়াসিসের প্রাদুর্ভাব বাড়িয়ে তোলে।
দ্ব শারীরিক আঘাত: যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনায় ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরবর্তী সময়ে সোরিয়াসিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
দ্ব ওষুধপত্র: কিছু কিছু ওষুধ সোরিয়াসিস বাড়াতে অনুঘটকের মতো কাজ করে। এই ওষুধগুলোর মধ্যে অন্যতম: লিথিয়াম, ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ওষুধ, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ ইত্যাদি।
সোরিয়াসিসের প্রকারভেদ :
সাধারণত ছয় ধরনের সোরিয়াসিস দেখা যায়:
১। পস্নাক সোরিয়াসিস: পস্নাক সোরিয়াসিস খুবই সাধারণ টাইপের এবং মোট সোরিয়াসিসে আক্রান্ত রোগীর ৮০-৯০ শতাংশ মানুষ পস্নাক সোরিয়াসিসে ভুগে থাকেন।
২। গাটেট সোরিয়াসিস: সাধারণত শৈশবে হয়ে থাকে। এই টাইপের সোরিয়াসিসে বাহু বা পায়ে ছোট ছোট গোলাপি বা বেগুনি দাগ সৃষ্টি হয়।
৩। পাস্টুলার সোরিয়াসিস: প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে পাস্টুলার সোরিয়াসিস বেশি দেখা যায়। আক্রান্ত স্থানে সাদা, পুঁজেভরা ফোস্কার মতো সৃষ্টি হয়। এটি সাধারণত হাত ও পায়ের ত্বকে ব্যাপক আকারে হয়।
৪। ইনভার্স সোরিয়াসিস: ইনভার্স সোরিয়াসিসে আক্রান্ত স্থান লাল হয়ে থাকে। এটি বগল বা স্তনের নিচে, কুঁচকিতে বা যৌনাঙ্গের ত্বকের ভাঁজের চারপাশে হয়ে থাকে।
৫। এরিথ্রোডার্মিক সোরিয়াসিস: এটি খুব গুরুতর এবং বিরল ধরনের সোরিয়াসিস। এটিতে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন হুমকির মুখে পড়ে।
৬। নেইল সোরিয়াসিস: হাত ও পায়ের নখে হয়ে থাকে।
সোরিয়াসিসের লক্ষণ:
সাধারণত ব্যক্তিভেদে এবং সোরিয়াসিসের ধরনের ওপর নির্ভর করে লক্ষণগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে:
১. আক্রান্ত স্থানের ত্বক লাল বা বাদামি রং ধারণ করে।
২. শুষ্ক ত্বকে এই সমস্যা দিলে আক্রান্ত স্থানে ফাটল দেখা দেয় এবং রক্তপাত হতে পারে।
৩. আক্রান্ত স্থানের চারপাশে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
৪. আক্রান্ত স্থানের চারপাশে চুলকানি অনুভূত হতে পারে।
৫. অস্থিসন্ধিগুলো ফুলে যেতে পারে এবং ব্যথা অনুভূত হয়।
৬. হাত ও পায়ের নখ অতিরিক্ত পুরু হয়ে যায়।
সোরিয়াসিস নিয়ন্ত্রণে করণীয়:
সোরিয়াসিসের কোনো প্রতিকার নেই। তবে এর মাত্রা ও ব্যথা কমাতে এবং আক্রান্ত ত্বকীয় কোষের বৃদ্ধি স্বাভাবিক রাখতে প্রচলিত কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়:
১. আক্রান্ত স্থানে ক্রিম বা মলম প্রয়োগ করে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের সোরিয়াসিস কমানো যেতে পারে।
২. মাঝারি থেকে গুরুতর সোরিয়াসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের, যারা সাধারণ চিকিৎসায় ভালোভাবে সাড়া দেয় না, তাদের মুখে খাবার ওষুধ বা ইনজেকশন ব্যবহার করতে হতে পারে।
৩. মাঝারি ধরনের সোরিয়াসিসের ক্ষেত্রে অতিবেগুনি রশ্মি ব্যবহার করে সক্রিয় শ্বেত রক্তকণিকাকে মেরে ফেলা হয়- যা সুস্থ ত্বকের কোষকেও আক্রমণ করে এবং দ্রম্নত কোষের বৃদ্ধি ঘটায়। আলট্রা ভায়োলেট এ ও বি রশ্মি হালকা থেকে মাঝারি সোরিয়াসিস কমাতে সহায়ক।
৪. পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ সুষম খাদ্য গ্রহণ সোরিয়াসিস থেকে দূরে রাখতে পারে। এমন সব খাবার খাওয়া উচিত যা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে। এতে করে এই রোগ থেকে দূরে থাকা যাবে।
৫. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এতে করে এ ধরনের চর্ম রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তাই ওজন সর্বদাই বিএমআই অনুযায়ী রাখা উচিত।
৬. স্যাচুরেটেড ফ্যাট যা প্রাণীজ উৎস থেকে পাওয়া যায়, যেমন- মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবার পরিমিত খাওয়া উচিত।
৭. স্যামন, সার্ডিন এবং চিংড়ির মতো সামুদ্রিক মাছ যা ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডসমৃদ্ধ ফ্যাটহীন, এমন প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি বেশি করে খাওয়া উচিত।
৮. এ ছাড়া উদ্ভিজ্জ ফ্যাট, যেমন- আখরোট, শণের বীজ এবং সয়াবিনসহ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডসমৃদ্ধ উদ্ভিজ্জ উৎসগুলোও সোরিয়াসিস প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৯. সোরিয়াসিস বৃদ্ধি করে এমন সব খাবার, যেমন- লাল মাংস, পরিশোধিত চিনি, উচ্চ প্রক্রিয়াজাত খাবার, অ্যালকোহল পান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
১০. অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার নিয়মিত খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে।
ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, নীলফামারী সদর, নীলফামারী।