সারা বিশ্বের অগ্রগতিকে থমকে দিয়েছে মহামারি করোনা। তরুণদের নৈতিক অবক্ষয়, মাদকের সহজলভ্যতা, বেকারত্ব, পারিবারিক কলহ, পারিবারিক অভাব অনটন, প্রিয়জনকে হারানো, ডিভাইসে আসক্তি, একাকীত্ব মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির মূল কারণ। সুস্থ মানসিকতার জন্য খুবই প্রয়োজন স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিগুলোতে কাউন্সিলিং, গুড প্যারেন্টিং এবং ডোপ টেস্ট আবশ্যক বলে আমি মনে করি। করোনার প্রচন্ড মানসিক চাপে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। কারণ দীর্ঘ সময়ের রুটিন মাফিক নিয়মের পরিবর্তন, বন্দি হয়ে দিন কাটানোতে খুব বেশি ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়েছে বিভিন্ন বয়সের মানুষ।
ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে অতিরিক্ত গেম আসক্তিতে পরবর্তী পর্যায়ে দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাধা পাচ্ছে মানসিক বিকাশ, একটানা দীর্ঘ সময় স্মার্টফোন, ট্যাব, কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকায় ক্ষীণদৃষ্টি বা মায়োপিয়ার আক্রান্ত হচ্ছে। পাশাপাশি তারা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে, পড়াশোনায় বিমুখ হয়ে পড়ছে এবং ক্রমান্বয়ে একাকীত্বের জাল বুনন করছে। নিজস্ব জগতে তখন শিশুরা বাবা-মা, ভাইবোন বা বন্ধু-বান্ধবের সংস্পর্শ খুব একটা পছন্দ করছে না। একাকী ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসে নিমগ্ন থাকতে ভালোবাসে। ফলে তাদের মধ্যে জেদ হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, সহিংসতা, একা থাকার মানসিকতা বেড়ে চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ডিভাইসের ইলেকট্রলাইটিক রেডিয়েশন মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক ফলে ঘাড়ে ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের দৃষ্টিশক্তি লোপ পাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ঘুমের সমস্যা বা নিদ্রাহীনতা, অতিরিক্ত ডিভাউস ব্যবহারের ফলে শরীরে মেলাটোনিনের ঘাটতি দেখা যেতে পারে। এছাড়াও ক্রমান্বয়ে ফ্লিপ ডিজঅর্ডারের ঝুঁকি বাড়তে পারে। আরেকটি বড় সমস্যা হলো কানে কম শোনা। ডিপ্রেশন, মানসিক চাপ, বিষণ্নতা ইত্যাদি কমাতে অল্প বয়সি ছেলেমেয়েরা মাদক আসক্তিতে সাময়িক সময়ের জন্য জড়িয়ে পড়ে। মাদকাসক্তের বড় অংশ মানসিক চাপে পড়ে মাদক গ্রহণ শুরু করে। হাজার হাজার কিশোর-কিশোরীসহ নানা বয়সের মানুষ আটকে পড়ে মাদকের দুর্ভেদ্য জালে। পারিবারিক কলহ, প্রেমঘটিত জটিলতা, বেকারত্ব, নিঃসঙ্গতা, মানসিক চাপ, তীব্র বিষণ্নতা থেকে, মাদকাসক্তি ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে হতাশা, সম্পর্কে টানপোড়ন, মা-বাবার সঙ্গে অভিমান বা অন্যের প্ররোচনায় অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। পরিসংখ্যান হতে দেখা যায়, ৯০ শতাংশই মানসিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করে এর মধ্যে মুড ডিসঅর্ডার, মাদকাসক্তি ও সিজোফ্রেনিয়া। তিনভাবে আত্মহত্যা সংঘটিত হতে পারে (১) আত্মকেন্দ্রিক (২) পরার্থমূলক আত্মহত্যা (৩) নৈরাজ্যমূলক আত্মহত্যা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ বিষণ্নতা, আর একার কারণেই দুই তৃতীয়াংশ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। ক্যানাডার গবেষকেরা দেখেছেন আত্মহত্যা প্রবণ ব্যক্তির মস্তিষ্কে গ্যাবা (এঅইঅ বা গামা অ্যামিনোবিউটাইরিক এসিড) গ্রহণকারী ব্যবস্থা বা রিসেপটরগুলোর বিন্যাসে অসামঞ্জস্য রয়েছে। ছেলেদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও বাংলাদেশে এই হার নারীদের মধ্যে বেশি। আসলে মানসিক স্বাস্থ্য ছাড়া সুস্থ শারিরীক স্বাস্থ্য চিন্তাই করা যায় না।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন আত্মহত্যাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা না করে সামাজিক ও মানসিক সংকট হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। আসলে আমাদের সব সময় একটি জিনিসের ওপর খেয়াল রাখতে হবে কঠোর আইন বা শাস্তি দেওয়ার চেয়ে কেউ যেন মানসিকভাবে অসুস্থ না হয় সেজন্য অনেক বেশি পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শিক্ষা প্রয়োজন। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তথ্যযুক্ত লিফলেট ইসু্য, সেমিনার ও কাউন্সিলি য়ের মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। দিন দিন এ সমস্যা আমাদের উৎকণ্ঠার দিকে নিয়ে চলেছে। পারিবারিক আলোচনা অত্যাবশ্যকীয়, প্রয়োজন নিবিড় ভালবাসার, মনের যত্ন প্রয়োজন, মন খারাপকে অবহেলা করা যাবে না, দীর্ঘস্থায়ী দুশ্চিন্তা, মানসিক অসুস্থতার জন্য দায়ী। প্রতিটি সন্তানকে পজিটিভ ও নেগেটিভ অর্থাৎ জীবনের দু'টি পিঠ সম্পর্কে খুব ভালো করে ধারণা দিতে হবে। কারণ কখনোই যেন জীবনে নেগেটিভ কিছু আসলে সন্তান ভেফু না পড়ে, নিরাশ না হয়ে যায়। জীবনে সফলতা কখনোই খুব সহজে আসে না। জীবনের পথটা সরলরেখায় চলে না। উঁচু নিচু পথে সামাজিক, মানসিক ও আর্থিক সমস্যা আসতে পারে। তখন নিরাশ না হয়ে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। মাদকাসক্তি বা আত্মহত্যা কোনটাই তার সমাধান না। আসলে জীবনের টানাপোড়ন সবই এক সময় ঠিক হয়ে যায় প্রয়োজন হয় শুধু সময়ের, সেই সঙ্গে ধৈর্য সহকারে মোকাবেলা করা। পারিবারিক সুন্দর বন্ধনই পারে একজন সুসন্তান তৈরি করতে। ব্যতিক্রম হতে পারে তবে তা কখনোই উদাহরণ হিসেবে গণ্য হবে না। একটি সুসন্তানই হতে পারে পরিবার, সমাজ, জাতি এবং দেশের ভবিষ্যৎ। গবেষণায় দেখা গেছে, আত্মহত্যা সম্পর্কে সচেতনামূলক আলোচনা যত বাড়ে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ততটাই কমে যায়। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা ঘটনা ঘটে চরম বিষন্নতা বা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন থেকে। অধিকাংশ মানুষ খুব একটা পরিকল্পনা করে আত্মহত্যা করে না। মনোবিজ্ঞানী বলেন আত্মহত্যা দু ধরনের হয়। পরিকল্পিত এবং আবেগতাড়িত হয়ে, কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কারও মধ্যে আত্মহত্যার ইচ্ছা বা প্রবণতা দেখা দিলে সবচেয়ে কাছের মানুষের কাছে তা শেয়ার করুন হতে পারে পরিবারের কেউ, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব, যদি সম্ভব হয় দেরি না করেও সাইকোলজিস্ট সাইক্রিয়াটিস্ট অথবা রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
আমরা জানি প্রতিটি বাবা মাই তার সন্তানকে প্রচন্ড ভালোবাসেন। কিন্তু তাদের আদর ও শাসন করার ধরন ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু মনে রাখতে হবে অতিরিক্ত আদর বা শাসন কোনটায় সন্তানের জন্য মঙ্গলজনক নয়। তাই সন্তানের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ গড়ে তুলুন যাতে সন্তান ভালো ও মন্দ দু'টিই পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করতে শেখে। সেইসব সন্তানের বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে।
আসলে পরিবারের কারো মধ্যে কোনো রকম অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করলে দেরি না করে তাকে নিয়ে রেজিস্ট্র্রার্ড কোনো চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। শুধু চিকিৎসা দিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব না। পরিবারের সদস্যদের আদর, ভালোবাসা, খাদ্যাভ্যাস ও সঠিক চিকিৎসার প্রয়োজন। পরিবারের কেউ যদি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে তাহলে তাকে অবজ্ঞা বা অবহেলা না করে বরং তাকে সাহস দিয়ে আগামী পথ চলার শক্তি অর্জনে ভূমিকা রাখুন। একটি সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় শরীরের পাশাপাশি মনের যত্ন নিই।
ডা. সামিনা আরিফ
অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত), সহযোগী অধ্যাপক
বি ফার্ম (অনার্স), এম ফার্ম. এমবিএ (এইচআরএম)
ডি এইচ এম এচ., পি.ডি.টি.
ফেডারেল হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা
৮৭-৯২/বি, গ্রীণ রোড, ফার্মভিউ সুপার মার্কেট (৫ম ও ৬ষ্ঠ তলা),
ফার্মগেট, ঢাকা। ই-মেইল আইডি: ংধসরহধধৎরভ৭৪১@মসধরষ.পড়স