বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, সতর্ক দেশ

বিভিন্ন দেশে নতুন করে সংক্রমণের হার বাড়ছে এবং দ্বিতীয় ঢেউয়ের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে পুরোপুরি বা শহরভিত্তিক কঠোর লকডাউন এবং কারফিউ শুরু করেছে। এমনকি শীতপ্রধান দেশগুলোতে সংক্রমণের হার জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে বলে লক্ষ্য করা গেছে।
হাসান মোলস্না
  ১৮ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শীতকালে আসতে পারে, সংক্রমণের হারও বাড়তে পারে। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এর জন্য জনগণকে সতর্ক থাকার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। মোকাবিলা নেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের প্রস্তুতি। বাড়ানো হচ্ছে জনসচেনতা।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউকে সামনে রেখে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ডের টিকা কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সে লক্ষ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী দেড় কোটি মানুষের জন্য তিন কোটি ডোজ টিকা পাবে বাংলাদেশ। ভারত থেকে কেনা হলেও টিকাটির মূল ফর্মুলা অক্সফোর্ডের। যে কারণে এর কার্যকারিতা বা স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়ে বেশ আশ্বস্ত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। করোনা প্রতিরোধে অক্সফোর্ডের আবিষ্কৃত টিকা কিনতে সরকারের আগ্রহকে স্বাগত জানিয়েছেন তারা। টিকা প্রয়োগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ করার পরামর্শ তাদের।

এদিকে বিভিন্ন দেশে নতুন করে সংক্রমণের হার বাড়ছে এবং দ্বিতীয় ঢেউয়ের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে পুরোপুরি বা শহরভিত্তিক কঠোর লকডাউন এবং কারফিউ শুরু করেছে। অনেকে মনে করছেন দেশের প্রথম ঢেউ তো শেষ হয়নি, সেখানে দ্বিতীয় ঢেউ আদৌ হবে কিনা, কিংবা তা হলে কতটা গুরুতর হবে, এ সব নিয়ে সংশয় রয়েছে এবং বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান থেকে এমনকি উচ্চমহল থেকে সতর্কবাণী করা হচ্ছে।

পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশে একই অবস্থা। শহর ও গ্রামে মানুষ নির্ভয়ে চলাফেরা করছে, অনেকেই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। স্কুল না খুললেও শিশুদের নিয়ে বাবা-মায়েরা বাইরে যাচ্ছেন। শিশুরা সতর্ক থাকতে পারে না বলে ক্যারিয়ারে পরিণত হয়। নিজেদের উপসর্গ না হলেও পরিবারে বয়স্কদের সংক্রমিত করছে তারা। যেহেতু জনসমাগম বেড়ে চলেছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বালাই নেই, জনসাধারণের মধ্যে একটা উদাসীনতা বা শৈথিল্যভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এমনকি নূ্যনতম মাস্ক পরারও তোয়াক্কা নেই এবং অনেকেই শারীরিক দূরত্ব মেনে চলছেন না, তাই অদূর ভবিষ্যতে সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকি আছে। বিশেষ করে শীতে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়, কোভিড-১৯ কিন্তু শুরু হয়েছিল গত শীতেই, যা চীনে পুরো শীতকালটায় তান্ডব চালিয়েছিল। এমনকি শীতপ্রধান দেশগুলোতে সংক্রমণের হার জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলেছে বলে লক্ষ্য করা গেছে। এ ছাড়া গবেষকরা বলেন, যে কোনো ভাইরাস শীতল ও শুষ্ক আবহাওয়া পছন্দ করে। আর শীতে বাতাসের আর্দ্রতাও কমে, আবহাওয়ার পরিবর্তন এসে শুষ্ক হয়ে যায়। তা ছাড়া শীতে মানুষের দরজা-জানালা বদ্ধ ঘরে থাকার প্রবণতা বাড়ে, ফলে অ্যারোসল ছড়ায় বেশি। আর তাই বদ্ধ ঘরে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি। এমনিতেই শীতকালে মানুষের নানা ধরনের রোগ-ব্যাধি যেমন- ফ্লু, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ (হাঁপানি বা ব্রঙ্কাইটিস) বাড়ে এবং প্রতি বছর এ ধরনের রোগীতে শীতকালে বাংলাদেশের হাসপাতাল পূর্ণ হয়ে যায়। তা ছাড়া শীতকালে দুনিয়াজুড়ে বয়স্ক ও শিশুদের ফুসফুস সংক্রমণজনিত মৃতু্যহারও সবচেয়ে বেশি হয়। উপরন্তু এ বছর অনেক নবজাতক শিশু লকডাউন ও মহামারির কারণে যথাসময়ে সব টিকা পায়নি। সারা পৃথিবীতেই এ অবস্থা। ফলে এবার শীতে অনেক বেশিসংখ্যক শিশু নিউমোনিয়া, হুপিং কফ, হাম, মাম্পস ইত্যাদিতে আক্রান্ত হবে বলে এখনই ধারণা করা হচ্ছে। এমনকি কোভিডসহ অন্যান্য ফুসফুসের সংক্রমণ বাড়বে, তা ধারণা করাই যায়। কারণ এখনো করোনা সংক্রমণ না নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, না এর টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ছাড়া শীতকালে সংক্রমণের হার আরও বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো এ সময়ে আমাদের ঘোরাঘুরি, নানা উৎসব, অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে-শাদি, পিকনিক, ওয়াজ-মাহফিল, মেলা, সেমিনার সিম্পোজিয়াম, সাংস্কৃতিক কাজকর্মসহ গণজমায়েত বেড়ে যায়। কাজেই এ সব অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়বে। করেনায়া মোকাবিলায় প্রস্তুতির বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে- শুধু জানলে হবে না, মানতেই হবে। ঘরের বাইরে গেলে অবশ্যই মুখে মাস্ক পরতে হবে। অপ্রয়োজনে বাইরে যাবেন না। কাজ শেষে দ্রম্নত বাড়ি ফিরে আসতে হবে। বাইরে গেলে যথাসম্ভব শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বাস-ট্রেন-লঞ্চ, হাটে-বাজারে-দোকানে, রাস্তা-ঘাটে এমনকি হাসপাতালের আউটডোর-ইনডোরসহ সব জায়গায় গায়ের ওপর গা দিয়ে চলাচল বন্ধ করতে হবে। বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস অব্যাহত রাখতে হবে। হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে। অসুস্থবোধ করলে, জ্বর, কাশি বা গলা ব্যথা, স্বাদহীনতা দেখা দিলে উপসর্গ যত মৃদুই হোক, নিজেকে সবার কাছ থেকে আলাদা করে ফেলার পাশাপাশি পরীক্ষা না করা বা চিকিৎসকের পরামর্শ না নেওয়া পর্যন্ত বের হওয়া যাবে না। এ সময় বাড়ির সবার কাছ থেকেও দূরে থাকতে হবে। অনেকেরই মৃদু উপসর্গ হচ্ছে, আর তা নিয়েই সবাই বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, যা কোনোভাবে কাম্য নয়।

শীতকালে যে কোনো রকম জনসমাগম, উৎসব, অনুষ্ঠান, ভিড় এড়িয়ে চলুন। এগুলো করতেই হলে সীমিত পরিসরে অল্পসংখ্যক মানুষ নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে করুন। যারা বয়স্ক ব্যক্তি বা যারা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত যেমন : উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, কিডনি বা লিভারের রোগ, স্ট্রোক বা জটিল সমস্যায় আক্রান্ত, তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি কিন্তু ততটা কমেনি, বরং বেড়েই চলছে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাদের বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না। আলাদা ঘরে রাখা এবং তাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা পরিবারের অন্যান্যদের গুরুদায়িত্ব। অন্যদিকে যারা বাইরে থেকে ঘরে আসবেন, তারাও এ সব ব্যক্তির কাছে যাবেন না বা প্রয়োজনে সতর্কতার সঙ্গে তাদের সঙ্গে মিশবেন। শীতের আগে ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং নিউমোনিয়ার টিকা ঝুঁকিপূর্ণদের দিয়ে দেওয়া ভালো।

করোনা মোকাবিলায় প্রশাসনিক প্রস্তুতি বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু শীতে সংক্রমণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে, তাই প্রশাসনকেও আগে-ভাগেই সতর্ক ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। 'মাস্ক ছাড়া কোনো সেবা নয়', এটাকে শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবে পরিণত করতে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া সংক্রমণ শনাক্তের টেস্ট, ট্রেসিং, আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টিন যাতে বাস্তবায়িত হয়, তারও ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ ইতিমধ্যে এ সব ব্যবস্থাপনায় গাছাড়া বা ঢিলেঢালা ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের করোনা পরীক্ষা এবং কোয়ারেন্টিন মানার ব্যাপারে বাধ্য করতে হবে। ডাক্তার, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তাসহ তাদের মানসম্মত সুরক্ষা সামগ্রীর যেন ঘাটতি না থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। কোনোক্রমেই যেন আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা স্থবির হয়ে না পড়ে, টেস্ট বা পরীক্ষা নিয়ে জনসাধারণকে যেন ভোগান্তি এবং তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার না হতে হয়, সেদিকটাও নিশ্চিত করতে হবে। কোনোভাবেই পরীক্ষার এবং চিকিৎসার নামে প্রতারণা যেন না হয়, সেদিকে শুরু থেকেই নজরদারি বাড়ানো দরকার।

জনগণ ও সরকারের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া কোনো পরিস্থিতি থেকেই উত্তরণ সম্ভব নয়। দুর্নীতিবাজ, সুবিধাবাদী, স্বার্থপর, মুনাফাখোর এবং লোভী, যারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে