বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বীর রতনের রেডিও

জুবায়ের দুখু
  ০৭ মার্চ ২০২০, ০০:০০

সারা গ্রামজুড়ে কোনো টেলিফোন বা টেলিভিশন যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। শুধু সবুজ অরণ্যে ভরা তাই গ্রামটির নাম সবুজপুর। গ্রামের তরুণ ছেলে রতনের কাছে একটি রেডিও আছে। সেই রেডিও আবার রতনের ফুপাতো ভাই বিদেশ থেকে রতনকে পাঠিয়েছে। রতন রেডিও থেকে খবর শুনে সারা গ্রামময় ছড়িয়ে দেয় কখন কোথায় কি হচ্ছে। আজকাল দেশের দিন বেশ ভালো যাচ্ছে না। রেডিওতে শুধু বলছে যখন-তখন যুদ্ধ লেগে যেতে পারে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের। রতন সে খবর ও সর্বদা গ্রামে ছড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষকে সজাগ থাকার আগ্বান করে বেড়াচ্ছে এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলছে। কারণ রতন ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছে। বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছেন তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবিলা করো। তাই রতনও নিজে নিজে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় রতনের এই যুদ্ধের খবর সবাই উড়িয়ে দিচ্ছে। কেউ-ই তেমন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে না। তবু রতন যখন যে খবর পায় মানুষকে তা আগ্রহ নিয়ে জানিয়ে দেয়।

দুদিন আগে পঁচিশে মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাক হানাদার এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকার বুকে। পিশাচের মতো মানুষকে খুন করে ঢাকাকে গড়ে তুলেছে মৃতু্যর নগরী, সেই সঙ্গে পাক-বাহিনীরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় পাকবাহিনী হামলা বা অত্যাচার চালাতে পারে এসব খবর সবসময় প্রচার করছে রেডিও চ্যানেলগুলো। এমন খবর শুনে রতন ভীষণ ভড়কে যায়। সেদিন থেকে কঠোর প্রস্তুতি নিয়ে আছে রতন।

আজ সকালে রতন রেডিও চালু করতেই রেডিও থেকে খবর শোনা যায় তাদের পাবনা জেলাসহ জেলার সব থানা উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনী ঢুকে পড়েছে এবং অসংখ্য হামলা চালাচ্ছে। খবরটি পেয়ে রতন মনস্থির থাকতে পারে না। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় গ্রামের ঘরে ঘরে মানুষের দুয়ারে। এবার গ্রামবাসী রতনের কথা আমলে নেয়। কারণ গতকাল সন্ধ্যায় আউয়াল হুজুর লক্ষ্ণীপুর গ্রাম থেকে ইমামতী করে যখন বাড়ি ফিরছিলেন তখন তিনি কয়েকজন পাকবাহিনী দেখেছে লক্ষ্ণীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায়। তারা নাকি কালই এসেছে লক্ষ্ণীপুর গ্রামে এবং এসেই লক্ষ্ণীপুর পূর্বপাড়ায় একটি মহলস্নায় আগুন লাগিয়ে দেয়। আউয়াল হুজুর ও রতনের কথা এবার গ্রামের মানুষ ভীষণ সতর্ক হয়। একদিন, দুদিন এভাবে ছয়দিন পার হয়ে যায়। এরই মধ্যে রতন রেডিও থেকে আরও কিছু তথ্য নিয়ে গ্রামে একটা মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলে। পিশাচের দল পাকবাহিনী তাদের গ্রামের ঢুকলে যেন যুদ্ধ করতে পারে এজন্য।

এপ্রিলের ৩ তারিখ ভোরবেলা কিছু পাকবাহিনী ঢুকে পড়ে সবুজপুর গ্রামে। ছিন্নভিন্ন করে দেয় আভাসপত্র। আগুন লাগিয়ে দেয় কয়েকটি বাড়িতেও। এদিকে রতন এই খবর পেয়ে তার মুক্তিবাহিনী নিয়ে গা ঢাকা দেয় সবুজপুর গ্রামের একটি জঙ্গলে। কারণ তারা রাতে অপারেশনে যাবে। এ জন্য রতনের আউয়াল হুজুরের সহযোগিতা প্রয়োজন তাই কাউকে দিয়ে আউয়াল হুজুরকে জঙ্গলে আসার খবর পাঠান। খবর পেয়ে আউয়াল হুজুর ছুটে আসে ইছামতীর কোলঘেঁষে ওই জঙ্গলে। হুজুর আসতেই রতন একটু স্বস্তি ফিরে পায়। তারপর হুজুরকে বুঝিয়ে বলে গোপনে পাকবাহিনীর দোসর সাজতে তাদের সঙ্গে মিল দিয়ে সব খবরাখবর দিতে। আউয়াল হুজুর রাজি হয় রতনের এমন বুদ্ধি দেখে। বুদ্ধি নিয়ে আউয়াল হুজুর চলে আসে জঙ্গল থেকে এবং পাকবাহিনীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে ভীষণ। পাকবাহিনীর খাবার ঘুমানোর সব ব্যবস্থা করে দেয় আউয়াল হুজুর এতে পাকবাহিনীর খুব নিকটবর্তী লোক হয়ে ওঠে তিনি। অথচ আউয়াল হুজুর গোপনে পাকবাহিনীর সব খবরাখবর রতনের মুক্তি বাহিনীর কাছে পাঠায় তার টুটি পরিমাণ কথাও জানে না পাকিস্তানি বাহিনী। ৬ এপ্রিল সন্ধ্যার আগে আউয়াল হুজুর আবারও রতনের খবরে জঙ্গলে যায়। এবং সব ঘটনা খুলে বলেন। তারা কখন ঘুমায় কখন খাবার খায় এসব ঘটনা। হুজুরের কথা শুনে রতন বলে পাকবাহিনীর ওপর হামলা করতে হলে রাতেই করতে হবে কারণ ওরা যখন ঘুমিয়ে যাবে তখন আমাদের অপারেশন করতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো বুদ্ধি নেই। রতনের কথায় সবাই সম্মতি দেয়, এবং আজ রাতেই অপারেশনে যাবে মনস্থির করে। আউয়াল হুজুরের কথা মোতাবেক রতন ও তার দল রাত একটার সময় সবুজপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিছনে এসে উপস্থিত হয়। এদিকে রতনদের আসার অপেক্ষায় আউয়াল হুজুরও তৈরি ছিলেন। হুজুরসহ সবাই দলবেঁধে বিদ্যালয়ের পিছনে মিটিং করেন। আউয়াল হুজুরকে মিটিং শেষে আরেকবার পাঠানো হয় পাকবাহিনী গভীর ঘুমে ঘুমিয়েছে কিনা দেখার জন্য। অপারেশনের আগে আউয়াল হুজুর শেষবারের মতো দেখে আসে পাকবাহিনীদের তারপর রতনের মুক্তি বাহিনীর মনে সাহস দিয়ে অপারেশনে যেতে বলেন। হুজুরের কথা অনুযায়ী জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে রতনের দল অপারেশনে যায়। ঘুমন্ত পাকবাহিনী বুঝে ওঠার আগের গুলির পর গুলি বর্ষণ করে সব পাকবাহিনীদের মেরে ফেলে ওরা। তারপর বিজয়ের উৎসাহে চিৎকার করে জয় বাংলা বলতে থাকে। ওদের আনন্দ দেখে গ্রামের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা মানুষ বেরিয়ে আসে গ্রামের পথেঘাটে। এরপর কিছুক্ষণ আনন্দ মিছিল করে ঘরে ফিরে যায় সবাই।

সেইদিন রাতে গ্রামের মানুষ শান্তিতে ঘুমায়। পরদিন সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠে রতনদের বাড়িতে হাজির হয় এবং সবাই মিলে রতনের সাহসিকতার প্রশংসা করে ও তার রেডিও দিয়ে দেশের সব জায়গায় যুদ্ধের খবর নেয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<91421 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1