হাটখোলা নামের গ্রামটি নদীর তীরে অবস্থিত। নদীর ওপারে বিস্তৃত ফসলি জমি, আর চারদিকে সবুজের সমারোহে ভরা। প্রকৃতি যেন সেখানে সবুজের বর্ণে উদ্ভাসিত। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। তারা সারাদিন মাঠে কাজ করে, ঘাম ঝরায়। গ্রামের এক প্রান্তে রয়েছে একটি ছোট্ট বাজার, যেখানে প্রতিদিন মেঠোপথ ধরে লোকজন যাতায়াত করে।
এই গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে এক ছোট্ট কুঁড়েঘরে বাস করতেন এক বৃদ্ধা, যাকে সবাই 'বুড়ি মা' বলে ডাকত। তার দুকূলে কেউ বেঁচে ছিল না; স্বামী ও সন্তান অনেক বছর আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। স্বামীর ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে তিনি জীবনের বাকি সময় গ্রামেই কাটিয়ে দেন। বয়সের ভারে নু্যব্জ বুড়ি মা আগের মতো আর চলাফেরা করতে পারতেন না, অন্যের সাহায্য ছাড়া তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল না। যদিও গ্রামের সবাই তাকে শ্রদ্ধা করত, তবু খুব কম মানুষই তার কাছে যেত। একাকিত্ব ছিল তার নিত্যসঙ্গী, আর তাতেই তিনি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
তবে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল মিষ্টি নামে ১০ বছরের একটি মেয়ে। মিষ্টির কোনো দাদা-দাদি ছিল না, তাই সে বুড়ি মাকেই ভালোবেসে 'দাদি' বলে ডাকত। প্রতিদিন স্কুল শেষে মিষ্টি দাদির কাছে আসত আর তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছিল।
বুড়ি মা তেমন ভালো দেখতে পেতেন না। চশমা ছাড়া তার চোখে কিছুই পরিষ্কার দেখা যেত না, আর হাঁটার জন্য একটি লাঠিরও প্রয়োজন ছিল। মিষ্টি প্রতিদিন দাদির চশমা তুলে দিত, লাঠিটাও এগিয়ে দিত। এরপর তারা বসে গল্প করত। বুড়ি মা মিষ্টিকে তার শৈশবের গল্প, পুরনো দিনের কথা এবং গ্রামের ইতিহাস শোনাতেন। মিষ্টি মুগ্ধ হয়ে সব শুনতো।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে মিষ্টি দেখতে পেল বুড়ি মা অস্থির হয়ে আছেন। সে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'কী হয়েছে দাদি?'
বুড়ি মা বিষণ্নভাবে বললেন, 'আমার চশমা খুঁজে পাচ্ছি না রে। সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।'
মিষ্টি ঘরের প্রতিটি কোণ খুঁজলো- খাটের নিচে, আলমারিতে, টেবিলে কিন্তু চশমা কোথাও পাওয়া গেল না। বুড়ি মা চিন্তিত হয়ে পড়লেন, কারণ চশমা ছাড়া তার কোনো কাজ করা সম্ভব ছিল না। মিষ্টিও খুব মন খারাপ করল।
পরের দিন মিষ্টির মনে হলো, তার কিছু জমানো টাকা আছে। স্কুলের টিফিনের জন্য মা যে টাকা দিতেন, তা থেকে সে কিছুটা সঞ্চয় করেছিল। সেই টাকায় দাদির জন্য একটি নতুন চশমা কিনবে বলে সে সিদ্ধান্ত নিল। বাবাকে নিয়ে বাজারে গিয়ে মিষ্টি দাদির জন্য একটি নতুন চশমা কিনে সোজা দাদির কাছে চলে গেল।
চশমাটি হাতে তুলে দিয়ে মিষ্টি বলল, 'দাদি, দেখো, তোমার জন্য নতুন চশমা নিয়ে এসেছি।'
বুড়ি মা আনন্দে অভিভূত হয়ে চশমাটি হাতে নিলেন। চোখে দিয়ে দেখলেন, সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার। আনন্দে তার চোখে পানি চলে এলো। কাঁপা কণ্ঠে বললেন, 'তুই কত ভালো রে মা। তোকে কী বলে ধন্যবাদ দেব, জানি না। তোর মতো ভালো মেয়ে আমি কখনো দেখিনি।'
এরপর থেকে মিষ্টি ও বুড়ি মায়ের গল্প আরও জমে উঠল। মিষ্টি প্রতিদিন নতুন গল্প শোনার অপেক্ষায় থাকত, আর বুড়ি মা তার জীবনের নানা অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে ভালোবাসতেন। তাদের এই বন্ধন দিন দিন আরও গভীর হতে লাগল।
তবে সময়ের সঙ্গে বুড়ি মা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মিষ্টির বাবা ডাক্তার দেখালেন, কিন্তু ডাক্তার জানালেন যে, বুড়ি মা আর সুস্থ হবেন না। কিছু দিন মৃতু্যর সঙ্গে লড়াই করে বুড়ি মা চিরবিদায় নিলেন। বুড়ি মার মৃতু্যতে মিষ্টি ও তার বাবা গভীর শোকে ভেঙে পড়লেন। বাবাই বুড়ি মার দাফনের ব্যবস্থা করলেন।
বুড়ি মা চলে যাওয়ার পর মিষ্টির গল্প করার সঙ্গী আর রইল না। দাদির কথা মনে পড়লেই মিষ্টি অঝোরে কাঁদত। কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে চাইলেও সে কোনো কথা শুনতে চাইত না। প্রায়ই সে বুড়ি মার কবরের পাশে গিয়ে নীরবে বসে থাকত, চোখ দিয়ে ঝরে পড়ত দুঃখের অশ্রম্ন।