মেছের আলী ধান ক্ষেতের আইলে গিয়ে দাঁড়ায়। সোনালি রঙের ধান দেখে মন ভরে ওঠে। পুরো ক্ষেতের ধান পেকে গেছে। বড় বড় ধানের বাইল। ধানের বাইল দেখেই বোঝা যায় ধানের ফলন ভালো হয়েছে।
মেছের আলী মুখে বলে আল্হামদুলিলস্নাহ্।
আলস্নাহ আমার মুখ পানে তাকিয়েছে। আলস্নাহ আমার ইচ্ছা মতো ধান দিয়ে মন ভরিয়ে দিয়েছে।
মিরাজ মিয়া ধান কাটার শ্রমিক। শ্রমিককে গ্রামের মানুষ পৈরাত বা কামলা বলে। মিরাজ মিয়া, মেছের আলীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলল, মেছের আলী ভাই, ধান তো পেকে গেল, কাটবেন নি। কাটলে আমি কেটে দিমুনি।
মাঠে এ সময় অনেকেই ধান কাটা শুরু করে দিয়েছে। প্রায় সবার ক্ষেতেই ধান পাক ধরছে।
ধান তো কাটার দরকারও। মেছের আলী বলল, তাহলে কালই কেটে দাও, আমাকেও সঙ্গে নিও।
দুইজনে মিলেমিশে কাটা যাবে।
মিরাজ মিয়া বলল, ঠিক আছে। কাল তয় আসবোনে।
অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার একটা মজাই আছে, তা হলো কিছুটা শীত এসে যায় প্রকৃতিতে। তাই খুব একটা গরম লাগে না। আরামে ধান কাটা যায়।
মেছের আলী আর মিরাজ মিয়া সময়ে অসময়ে ধান কাটার মধ্যে রাখালিয়া গান গাচ্ছে। চাষিরা এখনো পলস্নীগীতি, রাখালিয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি এসব গান পছন্দ করে। মাঝে মাঝে ভাঙা গলায় গায়। সুরে-বেসুরে যাইহোক, আনন্দ পায় খুব তারা।
ধান কাটা শেষে বিকালে ধান বাড়িতে নেবে। মেছের আলীর জমিটিতে যেখানে সেখানে কোনো বাহন পৌঁছে না। তাই মাথায় করে নিতে হবে। হেমন্তকালে মাথায় করে ধান বাড়ি নেওয়া গ্রামের একটা ঐতিহ্য। কৃষকরা সারিবেঁধে মাথায় করে ধান নিয়ে এক পায়ে রাস্তা দিয়ে বাড়ি যায়। সেই যে দৃশ্য তা দেখে মন ভরে না। বারবার দেখতে ইচ্ছে করে।
বাড়িতে নতুন ধান। সবার মনে আনন্দ। শুধু মানুষের মনে আনন্দ তা নয়, গরু, ছাগল, হাঁস মুরগীর ও আনন্দ হয়। কথায় আছে বাড়িতে মানুষের খাবার হলে গরু ছাগলের ও খাবার হয়। খাবার পেলে খুশি হয় না এমন প্রাণী নেই। বাড়িতে ধান এলে হাঁস মুরগীতে খায়, খুঁদ, কুঁড়ো ও খড় গরুতে খায়। নতুন ধানের ফ্যান ছাগলে ভালো খায়। তাই ছাগল ভারী খুশি হয় নতুন ধান বাড়ি এলে। মাঝে মাঝে কবুতর উড়ে এসে ধান খায়।
বাড়িতে ধান এলে সবাই কর্মব্যস্ত থাকে। ধানের আঁটি সাজানো, ধান রোদে ছড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি। আগে ধান মাড়াই করতে দেরি হতো। কষ্ট হতো অনেক। গরু দিয়ে মাড়াই করতে হতো। অনেক সময় লেগে যেত। এখন প্রযুক্তির কল্যাণে ধান মাড়াই করার মেশিন তৈরি হয়েছে। এখন মুহূর্তের মধ্যেই ধান মাড়াই হয়ে যায়। মেছের আলীর বাড়ির ধান মাড়াই হয়ে গেল। অনেক ধান হয়েছে। ধান দেখে সবার মন ভালো। সারা বছর ঘরে খাওয়া যাবে। ঘরে খাবার থাকলে চাষিদের আর চিন্তা থাকে না। গ্রামের চাষি পরিবারের লোকরা লবণ দিয়েই পেট পুড়ে খেয়ে উঠতে পারে। মেছের আলীর এখন খাওয়ার চিন্তা নেই। মেছের আলীর একমাত্র ছেলে নির্বাণ তার মাকে বলল, পিঠা বানাতে। নতুন ধানের পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। আর যদি হয় চিতই পিঠা! সবাই পেট পুরে করে খেতে পারে। আর যদি সঙ্গে থাকে হাঁসের মাংস। অমৃতের মতো লাগে। নির্বাণের মা চালের গুঁড়ি করতে গেল। পাড়ায় বেশি ঢেঁকি নেই। দুই একটা আছে। রাইচ মিলেও চালের গুঁড়ো করা যায়। তবে পিঠা ভালো হয় না। টেস্ট ও ভালো হয় না। ঢেঁকি ছাঁটা চালে চিতই পিঠা ভালো হয়। খেতে দারুণ হয়।
নির্বাণের আম্মু চালের গুঁড়ি করে নিয়ে এলো। গ্রামে চারিদিকে এখন শুধু ঢেঁকির আওয়াজ। বোঝা যায় গ্রামে নবান্ন উৎসব চলছে। এটা বাঙালিদের একটা বড় উৎসব। গ্রামে গ্রামে এই উৎসব সাড়ম্বরে পালন করে।
মেছের আলী, মিরাজ মিয়াকেসহ তার কয়েকজন বন্ধু, আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ করেছে রাতে। যথাসময়ে সবাই এলো।
তারা সবাই চুলার পাশে বসে গরম গরম চিতই পিঠা খাচ্ছে। এটা গ্রামের রেওয়াজ। নির্বাণ সবার সঙ্গে পিঠা খেতে লাগল। চাষিদের মনে এই নবান্নের আনন্দ তা ঈদের চেয়ে কোনো অংশে কম না। প্রতি বছর ধান ভালো হোক না হোক নবান্নের উৎসব পালন করে। মেছের আলীও প্রতি বছর পালন করে। মেছের আলীকে সবাই ধন্যবাদ ও দোয়া জানিয়ে- যার যার মতো চলে গেল। মেছের আলী মনে মনে আনন্দের ঢেঁকুর গিলে।
একা একাই মুছকি হাসি হাসতে লাগল। মুখে উচ্চারণ করল আল্হামদুলিলস্নাহ্।