গল্প

মামদো যখন বন্ধু

প্রকাশ | ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০

মোস্তাফিজুল হক
লিকলিকে চেহারা। পা দু'টো পাটখড়ির মতো শুকনো- যাকে বলে খ্যাংরা কাঠি। পিঠে একটা কুঁজ আর বুকের ছাতির সবকয়টা হাড় গোনা যাবে। চোখের মণি কোটরে ঢুকে গেছে। হাড় জিরজিরে চেহারার সঙ্গে গায়ের চামড়া এঁটে আছে। মাথায় জটাধারীর মতো উসকোখুসকো চুল। বিচিত্র চেহারার মামদো। নাম মামদো হলেও সে কখনো মামদোবাজি করে না। রাতের আলো-আঁধারিতে একা পথ চলতে গিয়ে এরকম চেহারা দেখে যে কারোর ভয় পাওয়ার কথা। হঠাৎ সামনে পড়লে দুঃসাহসীরও পিলে চমকে যাবে। তবে ১০ বছরের অপু মামদোকে দেখে একদমই ভয় পায় না। মামদোও থ্রি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। এক বছর থেকে পড়াশোনা বাদ। মানুষের ইশ্‌কুলে অভিভাবকহীন মামদোদের মূল্য নেই। ওরা কারোর নজরে পড়ে না, কিংবা সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। তবে ছুটির দিনে বিকালে অপু যখন গড়ের মাঠে খেলতে যায়, তখন মামদোকে ওর সঙ্গে খেলতে ডাকে। অপু মামদোর সঙ্গে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করে। মামদোর ক্ষিপ্র গতির বোলিংয়ে সে প্রায়ই বিধ্বস্ত হয়। ভূতুড়ে গতির বোলিংকে অপু কোনোভাবেই সামলাতে পারে না। সুঠাম দেহের অপু ভেবে অবাক হয়, 'এ রকম লিকলিকে চেহারার মামদো এত জোর পায় কোত্থেকে!' বোলিংয়ের মতোই ব্যাটিংয়েও কম যায় না সে। বারটা যদিও শুক্রবার, তবুও অপু আজ খেলতে যায়নি। যাবে কী করে- আজ যে পহেলা বৈশাখ। মান্দাখালি ঘাটের ওপারে বটতলায় বৈশাখি মেলা দেখতে গিয়েছিল সে। মেলা দেখে ঠিক সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ফিরছিল অপু। সহজ পথে বাড়ি ফেরার ইচ্ছে নিয়ে ধানী মাঠের সরু রাস্তা দিয়ে নীরবে পথ হাঁটছিল সে। মস্ত বড়ো বেড় শিমুল গাছটার নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ নিস্তব্ধ মাঠের পেছন থেকে ডাক শুনতে পেল : 'বড্ড খিদে লাগছে অপু ভাই। কতদিন হলো হাতি-ঘোড়া খাই না! ওগুলোর দুটো পেলে মজা করে চিবিয়ে খেতাম।' আবছায়া অন্ধকারে অপু প্রথমে ভড়কে গেলেও পরক্ষণেই টানটান হয়ে দাঁড়ায়। : 'আরে! মামদো, তুই এখানে কেন?' : 'কেন, তোমার পিছে পিছেই তো হাঁটছিলাম; তুমিই খেয়াল করনি।' : 'কিন্তু, তুই আমার পিছু নিয়েছিস কেন?' : 'ভাবলাম, শুনশান পথে যদি ভয় পাও, তা-ই!' : 'ওসব কথা বাদ দে, কেন পিছু নিয়েছিস, তা-ই বল?' : 'অনেক দিন হলো হাতি-ঘোড়া খাই না। দুটো পেলে একটু চেটেপুটে খেতাম।' এমন একটা ভয়ানক ঘটনাতেও অপু ভয় না পেয়ে বরং মামদোকে ভীষণ রেগে গিয়ে ধমক দিল! শুধু কি ধমক? দু'কথা শুনিয়েও দিল : 'কিনে খেতে পারিস না? আমার বাবার টাকায় কেনা হাতি-ঘোড়া দেখে এত লোভ কেন তোর?' : 'অপু ভাই, আমার তো বাবাও নেই, টাকাও নেই! তোমার সঙ্গে খেলতে দাও বলেই তো চেয়েছি!' মামদোর জবাবে অপু বেশ লজ্জিত হলো। নিজেকে খুব ছোটো মনে হলো ওর। তাই সে আর দেরি না করে পলিথিনের পুটলি থেকে কয়েকটি চিনির হাতি আর ঘোড়া বের করে দিল। তারপর অসহায় মামদোকে বলল, 'মন খারাপ করিসনে মামদো। তুই তো আমার খেলার মাঠের বন্ধু, তোকে এভাবে বলাটা আমার ঠিক হয়নি। আমি বাবাকে বলে তোর লেখাপড়ার ব্যবস্থা করব। সুযোগ পেলে তুইও একদিন সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবি।'