গল্প
সোনার পদ্মফুল
প্রকাশ | ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
খালিদ বিন ওয়ালিদ
সে বহুদিন আগের কথা। একজন রাজা তার দু'জন সৈন্যকে নিয়ে গহিন বনে শিকারে বেরিয়ে পড়ল। তারা বনে অনেক ঘুরাঘুরির পর ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তারা তিনজন একটি গাছের নিচে আশ্রয় নিল। তারা গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তাদের প্রচন্ড ক্ষুধাও পেয়েছে, তবে তাদের কাছে খাওয়ার মতো বেশি কিছু ছিল না। রাজা হঠাৎ গাছের দিকে তাকিয়ে দেখল, গাছে অনেক কালো রঙের আপেল ঝুলছে। কেউ এতক্ষণ সেটা লক্ষ্য করেনি। রাজা বলল, ওই যে দেখ গাছে কতগুলো আপেল ঝুলছে, চল কয়েকটা আপেল পেড়ে খাওয়া যাক। এতে আমাদের ক্ষুধা মিটে যাবে। একজন সৈন্য বলল, মহারাজ আমার তো খুব ভয় হচ্ছে, আমি এর আগে কোনো দিন কালো আপেল দেখিনি! আপেল খেলে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না তো? রাজা বলল, আরে বোকা, আপেল খেলে কি ক্ষতি হতে পারে? এটা তো একটা সুস্বাদু ফল। মুখ বন্ধ করে জলদি গাছে ওঠ দেখি, খুব ক্ষিধে পেয়েছে। একজন সৈন্য বলল, কিন্তু মহারাজা। রাজা তাকে থামিয়ে বলল, কোনো কিন্তু নয়, জলদি গাছে ওঠ। এবার একজন সৈন্য আপেল গাছে ওঠল। গাছে উঠে কয়েকটি আপেল পেরে ফেলল। তারা তিনজন মিলে আয়েশ করে কয়েকটি আপেল খেল। আপেল খাওয়ার কিছুক্ষণ পর তারা তাদের শরীরে কিছু পরিবর্তন দেখতে পায়। ধীরে ধীরে তাদের হাত-পা অসাড় হতে শুরু করে। তারা হঠাৎ নড়াচড়া করতে পারছে না। হঠাৎ তাদের পুরো শরীর মূর্তির মতো হয়ে শক্ত হয়ে গেল। তারা শুধু কথা বলতে পারছিল। একজন সৈন্য বলল, দেখেছেন মহারাজ কালো আপেল খাওয়ার পর আমরা সবাই মূর্তির মতো হয়ে গেলাম। আপেল খাওয়ার আগে একটু ভেবে দেখলে কি এমন ক্ষতি হতো? কালো আপেল খাওয়া আমাদের মোটেও উচিত হয়নি। রাজা বলল, তাই তো দেখছি! এখন আমাদের কে বাঁচাবে? এখান থেকে মুক্তির উপায় বা কি? তারা ওভাবেই মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। এভাবে করে অনেক দিন পেরিয়ে গেল। একদিন সে বনে একজন কাঠুরে কাঠ কাটতে আসে। সে অনেকক্ষণ কাঠ কেটে ক্লান্ত হয়ে আপেল গাছের ছায়ায় এসে বসে পড়ল। সে দেখল তার সামনেই কতগুলো কালো রঙের আপেল পড়ে আছে। কিন্তু সে জানে এ আপেল খেলে মানুষ মূর্তির মতো হয়ে যায়। আর সে এটাও জানে কীভাবে মূর্তি থেকে পুনরায় মানুষের রূপ ফিরে পাওয়া যাবে। তার একটু পাশেই ছিল রাজা ও দুই সৈন্যের মূর্তি। তারা কাঠুরেকে ডাকছে, কাঠুরে ভাই আমাদের বাঁচাও। আমরা বড্ড বিপদে পড়েছি। কাঠুরে ভাই, আমাদের বাঁচাও। কাঠুরে সে ডাক শুনতে পেয়ে মনে মনে ভাবছে- কেউ কি আমাকে ডাকছে? কিন্তু কে ডাকবে এ গহিন বনে? কাঠুরে এদিক ওদিক চোখ ফেরাল, সে রাজা ও তার দুই সৈন্যের মূর্তি দেখতে পেল। কাঠুরে তাদের কাছে গিয়ে বলল, আপনাদের এমন অবস্থা কীভাবে হয়েছ? আপনারা কি কালো আপেল খেয়ে ফেলেছিলেন? রাজা বলল, হঁ্যা। আমরা প্রচন্ড ক্ষুধার্থ ছিলাম তাই কোনো কিছু না ভেবেই কয়েকটি আপেল খেয়ে ফেলেছি, তুমি আমাদের বাঁচাও কাঠুরে। তুমি যা চাইবে আমি তোমাকে তাই দেব। আমি তোমাকে অনেক স্বর্ণমুদ্রা দেব। কাঠুরে বলল, মূর্তি থেকে পুনরায় মানুষ হওয়া তো খুব কঠিন, তবে একটা উপায় আছে। রাজা বলল, কি সেই উপায়? কাঠুরে বলল, এখান থেকে কিছুদূর গেলেই একটা গ্রাম আছে। সে গ্রামে তেমন মানুষ থাকে না। সেখানে যমদ্বৈত্যর প্রাসাদ আছে, যেখানে যমদ্বৈত্য থাকে। সে গ্রামের মানুষকে ধরে নিয়ে যায়। সে নাকি মানুষের রক্ত খেতে খুব ভালোবাসে। আমি শুনেছি সে গ্রামে কোথাও একটা পুকুর আছে, সে পুকুরে একটি সোনার পদ্মফুল আছে, যেটা যমদ্বৈত্যের প্রাণ। সে সোনার পদ্মফুল আপনাদের সারা শরীরের ছোঁয়ালে আপনারা পুনরায় মানুষের রূপ ফিরে পাবেন। সে সোনার পদ্মফুল আনতে হলে আগে তাকে হত্যা করতে হবে। তবে একটা বিপদ আছে? রাজা বলল, কেমন বিপদ শুনি? কাঠুরে বলল, সোনার পদ্মফুলটি এক কোপে কাটতে পারলেই যমদ্বৈত্য মারা যাবে। আর না পারলে যে কোপ মারবে সেই মারা যাবে। পুকুরে নামা মাত্রই যমদ্বৈত্য বুঝে যাবে পুকুরে কেউ নেমেছে। তাই যমদ্বৈত্য তাকে হত্যার জন্য ছুটে আসবে। রাজা আবারও বলল, কাঠুরে আমাদের সাহায্য কর! এবার রাজার দু'জন সৈন্য কাঁদতে কাঁদতে মিনতি করল, কাঠুরে ভাই আমাদের সাহায্য কর আমরা দু'জন চিরকাল তোমার দাস হয়ে থাকব। দেখ যমদ্বৈত্যেকে মারতে পারলে গ্রামের মানুষ অনেক শান্তিতে থাকতে পারবে। কাঠুরে বলল, আমি নিশ্চয়ই আপনাদের প্রাণ বাঁচাব, আপনাদের কোনো প্রতিদান দিতে হবে না। কাঠুরে এবার তার কুড়াল কাঁধে নিয়ে গ্রামের দিকে চলল। সে গ্রামে গিয়ে অনেক খোঁজাখুজির পর পুকুরটি দেখতে পেল। পুকুরের কাছে এসে দেখল, চারপাশে অনেক মাথার খুলি পড়ে আছে। পরিবেশটাও অনেক ভূতুড়ে। তাই কাঠুরে একটু ভয় পেল। তার আরও ভয় হচ্ছে যদি যমদ্বৈত্য পুকুরের কাছেই কোথাও থাকে তাহলে সে প্রাণ হারাতে পারে। সে ভাবছে আমারই না শেষে প্রাণ হারাতে হয়। সে মনে জোর নিয়ে তার ধারালো কুড়োল বের করে হাতের মুঠোয় পুরে নিল। তার পুরো শরীর কাঁপছে। সে ভয়ে ভয়ে পুকুরে নেমে পড়ল। পুকুরে পা পড়া মাত্রই যমদ্বৈত্য বুঝতে পারল পুকুরে কেউ নেমেছে। তাই সে কঠিন কণ্ঠে একটা হুঙ্কার দিয়ে উঠল। সে উড়ে উড়ে পুকুরের দিকে আসতে লাগল। যমদ্বৈত্য পুকুর পারে এসে দেখল কাঠুরে কুড়োল নিয়ে সোনার পদ্মফুলের প্রায় কাছে চলে গেছে। যমদ্বৈত্য রেগে গিয়ে বলল, কাঠুরে তুই সোনার পদ্মফুলের ক্ষতি করিস না- করলে আমি তোকে হত্যা করব। তুই বড্ড ভুল কাজ করছিস। দেখ, এখানে কত মাথার খুলি পড়ে আছে, আমি তোকেও হত্যা করব। তোর কি একটুও ভয় নেই! কাঠুরে যমদ্বৈত্যের কথায় কান না দিয়ে সোনার পদ্মফুলের দিকে ছুটে চলল। যমদ্বৈত্য এবার কাঠুরেকে ধরার জন্য ডানা মেলে তার দিকে উড়ে যাচ্ছে। কাঠুরে সাঁতরে সাঁতরে সোনার পদ্মফুলের কাছে গেল। পদ্মফুলের কাছে গিয়ে এক কোপে সোনার পদ্মফুল কেটে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে যমদ্বৈত্য লুটিয়ে পড়ল। তার শরীরে আগুন লেগে তার সমস্ত শরীর পুড়ে গেল। কাঠুরে সোনার পদ্মফুলটি নিয়ে আপেল গাছের কাছে ফিরে এলো। কাঠুরে তিনজনকে বলল, এই যে আমি সোনার পদ্মফুল এনেছি, এটা আপনাদের সারা শরীরে ছোঁয়ালে আপনারা পুনরায় মানুষের রূপ ফিরে পাবেন। কাঠুরে এবার রাজাসহ তার দুই সৈন্যের সারা শরীরে সোনার পদ্মফুল ছোঁয়ালো। যার ফলে, তারা পুনরায় মানুষের চেহারা ফিরে পেল। রাজা খুশি হয়ে বলল, কাঠুরে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ! তুমি খুবই সৎ ও চরিত্রবান একজন মানুষ। রাজা খুশি হয়ে কাঠুরেকে অনেক স্বর্ণমুদ্রা দিল। রাজা বলল, কাঠুরে এটাই তোমার পাপ্য ছিল। কথায় আছে না, যেমন কর্ম তেমন ফল।