কানাই পেশায় একজন জেলে। নদীতে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। তার বাপ-দাদারাও এই পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। দুই তিন যুগ আগে কানাইয়ের দাদা তিস্তার ভাঙনের ফলে অপর পাড়ে তিস্তা পাওয়ার পস্ন্যান্টের পাশে আলী বাবা থিম পার্কের কোল ঘেঁষে টিনের ছাপড়ায় কোনোরকমে জীবনযাপন করছেন। তিস্তার সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের সখ্যতা। ছোট্ট নৌকায় করে নদীতে মাছ ধরেন। তার ছোট ছেলে পাচু সহযোগিতা করার জন্য নৌকায় থাকে। একদিন বিকালবেলা কানাই ছেলেকে নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে গেল। মাঝ নদীতে নৌকা হঠাৎ আটকে গেল। কোনো দিকে যাচ্ছে না। সূর্য ডুবুডুবু সন্ধ্যা। কানাই নৌকা থেকে পানিতে নামল। হাঁটু জলের ওপরে পানি। এ পানিতে নৌকা আটকানোর কথা নয়। মনে মনে বিষয়টা নিয়ে ভাবছে। হঠাৎ কানাইয়ের পায়ে কি যেন নাড়া দিচ্ছে। বোয়াল মাছ ভেবে পানির ওপরে তুলে দেখে মস্ত বড় কুমির। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। আজ বুঝি কুমির খেয়েই ফেলে, কিন্তু না। কুমির তার নতুন বন্ধু কানাইকে পিঠে নিয়ে নদীর অগভীরে মাছের জায়গাগুলো দেখিয়ে নিয়ে এলো। ভয়ে কাঁপছে সে। পাচু তার বাবার এ রকম কান্ডে হতবাক। কেমন করে এ রকম হলো। বাবাও ছেলেকে কিছু বলছে না। মাছ না ধরে বাড়িতে যাবে সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু তাদের নৌকা হঠাৎ একা একা যাচ্ছে আপন গতিতে। কিছুদূর গিয়ে আবার এমনিতেই থেমে গেল। নৌকার আশপাশে মাছের ঝঁাঁক ছোটাছুটি করছে। বৈঠা দিয়ে পানির পরিমাণ মেপে নিল ওরা। পানি একেবারেই কম। মাছ দেখে মনের লোভ আর সামলাতে পারল না। দু'জনে জাল ফেলে নদীতে। হঠাৎ মাছগুলো ছুটোছুটি করে তাদের জালের দিকে ধেয়ে আসছে। আজ অন্য দিনের চেয়ে মাছ বেশি ধরা পড়েছে। মাছ দেখে ছেলে-বাবা খুশিতে আত্মহারা। এখন বাড়ি ফেরার পালা। নৌকা আবার একাই বাড়ির দিকে যাচ্ছে। কানাই লালের বুঝতে আর বাকি রইল না যে, কুমির তার পিছু লেগেছে। ঘাটে নৌকা বেঁধে বাড়িতে গেল। মাছ দেখে সবাই খুশি। অন্য ছেলেরাও হতবাক। কাউকে কিছু বলল না কানাই। ছেলেকেও নিষেধ করেছে। পরদিন একই সময়ে আবার নদীতে মাছ ধরতে গেল। কুমির ঘাটে বাঁধা নৌকার নিচে শুয়ে কানাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। পাচু কানাই নৌকায় ওঠামাত্র আবার একাই চলতে লাগল। অল্প পানিতে গিয়ে থামল। মাছের আনাগোনা দেখে জাল ফেলল। কুমির মাছের ঝাঁককে ধাওয়া দিলে জালের দিকে আসতে শুরু করে। জালের মাছ দেখে অনেক খুশি। তারা নিজেদের জন্য রুটি কলা নিয়েছিল তা কুমিরকে খেতে দিল। কুমির রুটি কলা খেয়ে আনন্দে আবার নদীর ঘাটে নৌকা পৌঁছে দিল। পাচু কানাইয়ের সঙ্গে কুমিরের এভাবে সখ্যতা গড়ে ওঠল। এভাবে তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক চলে দিনের পর দিন। একদিন কানাই হঠাৎ কলেরায় বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। পাচু ও নদীতে আর একা মাছ ধরতে যায় না। কুমির তার বন্ধুর জন্য ঘাটে দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকে। কিছুতেই ভুলতে পারে না কানাইয়ের কথা। কিন্তু সে পৃথিবীতে তো বেঁচে নেই- কীভাবে যাবে কুমিরের সঙ্গে দেখা করতে। কুমির কানাই লালের চিন্তায় দিনের পর দিন পানিতে ছটফটিয়ে উঁকি মারে কখন আসবে ভোরের আলোয় নদীতে মাছ ধরতে। নদীর পানি দিন দিন কমে যায় কিন্তু কানাই আর ফিরে আসবে না কোনো দিনও।