অন্তহীন জ্ঞানের উৎস হলো বই। আর সেই বইয়ের আবাসস্থল হলো পাঠাগার। যেখানে নদীর স্রোতের মতো জ্ঞান থাকে, বই থাকে। পাঠাগার শব্দটি সন্ধিবিচ্ছেদ করলে হয় পাঠ+আগার অর্থাৎ পাঠাগার হলো পাঠ করার উপাদান সজ্জিত আগার বা স্থান। বিশদভাবে বলা যায়, পাঠাগার বলতে এমন একটি স্থানকে বোঝায়, যেখানে জ্ঞানরাজ্যের বহু শাখার বিচিত্র গ্রন্থরাজি সংগৃহীত থাকে। পাঠাগার হলো শিক্ষার বাতিঘর। এটি ছাড়া কোনো সমাজ আলোকিত হতে পারে না। তাই এর প্রয়োজনীয়তা প্রতিটি সমাজে অনিবার্য।
মানুষ চিরদিন আলোর সন্ধানী। আলোর দিকে, সত্যের দিকে, উন্নতি ও সফলতার দিকে মানুষ সদা ধাবমান। আলোর পথে এগিয়ে মানুষ হতে চায় আলোকিত মানুষ। সত্য সুন্দর ও সমৃদ্ধির তৃষ্ণা তার বুকে চিরদিন প্রজ্বলিত থাকে। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অহিংসা, সাম্য এবং ভালোবাসার পৃথিবী গড়তে প্রয়োজন মানুষের মনুষ্যত্বের সঠিক বিকাশ, আর তার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন সুশিক্ষার। আর সুশিক্ষার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ, পড়ার পরিবেশ অর্থাৎ পাঠাগার। পাঠাগার মানুষের আলোকিত জীবন সংস্কৃতির প্রথম ও প্রধান আলোকবর্তিকা। পাঠাগার সত্য ও জ্ঞান আহরণের তীর্থস্থান, গবেষণাগার, সমাজের প্রজ্বলিত প্রদীপ, জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোর মশাল। অন্ধজনের চোখের আলো এবং সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে সেতুবন্ধন। শিক্ষা মানুষকে পূর্ণতা দেয়। আর একজন শিক্ষিত মানুষ গড়ে তোলেন আদর্শ সমাজ, আলোকিত সমাজ। পাঠাগার বিপুল বই সমৃদ্ধ নিতান্তই একটি কক্ষবিশেষ হলেও প্রকৃতপক্ষে পাঠাগারের আছে একটি সজীব প্রাণবন্ত গতিময় সত্তা, বই মানুষের উপলব্ধির ধারক ও বাহক। অসচেতন মানুষকে সচেতন, অশিক্ষিত মানুষকে শিক্ষার আলো দেখাতে প্রয়োজন পাঠাগার। পাঠাগার সংস্কৃতি, সভ্যতা ও মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের পথকে সুগম করে। প্রখ্যাত লেখক প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, 'এ দেশে লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু বেশি। আমি লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের ওপর স্থান দেই এই কারণে যে, এ স্থলে লোকে স্বেচ্ছায় স্বাচ্ছন্দ্যচিত্তে স্বশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়, প্রতিটি লোক তার স্বীয় শক্তি রুচি অনুসারে নিজের মনকে, নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।' আসলেই এটা চরম সত্যি যে, হাসপাতালের চেয়েও পাঠাগারের গুরুত্ব অনেক বেশি, কারণ হাসপাতাল বিশেষ মানুষের শারীরিক রোগ সারিয়ে তোলে; অন্যদিকে, পাঠাগার পুরো সমাজের, পুরো জাতির আত্মিক রোগ সারিয়ে তুলতে সক্ষম। সমাজের যত অন্যায়-অবিচার, দুঃশাসন নির্মূলে পাঠাগার সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। পাঠাগার জ্ঞানের আলো ছড়ায়। এ আলো আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে বিশ্বময়। পাঠাগারের আলোকবিভায় দশদিক হয়ে ওঠে পরিশুদ্ধ। বিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে একেকজন মানুষ পরিণত হয় উন্নত মানুষে। ধীরে ধীরে সমাজ হয় আলোকিত ও উন্নত। কারণ জ্ঞান মানুষকে বিনম্র করে, করে মহৎ। আর সে মহৎ মানুষকে নিয়েই গঠিত হয় আলোকিত সমাজ। সুতরাং, আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে পাঠাগারের গুরুত্ব অপরিসীম।