বিশ্বজিৎ ঘোষ আর শ্রেয়ার মাঝে বয়সের ব্যবধান অনেক। একজন জীবনের তেতালিস্নশটি বসন্ত পাড়ি দিয়ে এসেছেন, আরেকজন সবেমাত্র চতুর্থ বছরে পা দিয়েছে। সম্পর্কে চাচা ভাতিজি। বয়সের এত ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও বিশ্বজিৎ বাবুকে শ্রেয়া প্রায়ই তাক লাগিয়ে দেয়। শ্রেয়ার কচি মুখের পাকামিতে বিশ্বজিৎ থ' না হয়ে পারেন না।
শ্রেয়া জিজ্ঞেস করল- 'কাকাবাবু, মীরা দিদি কি খুব বুদ্ধিমতী ছিল?'
বিশ্বজিৎ উত্তর দিলেন, 'ছিলই তো, তোর চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধি ছিল তার।'
থমকে গেল শ্রেয়া। বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ওহ...'
বিশ্বজিৎ বুঝলেন চোখের সামনে অন্যের প্রশংসা আর নিজের অবমাননা কারও ভালো লাগে না। তাই তিনি আবার বললেন, 'তুই যে একেবারে নির্বোধ, তা কিন্তু নস। মাঝেমাঝে তোর মীরা দিদিকেও ছাড়িয়ে যাস বুদ্ধিতে।' এইবার শ্রেয়ার চোখে মুখে উজ্জ্বল হাসির আবাস দেখা গেল।
বিশ্বজিৎ ঘোষ সরকারি কলেজের অধ্যাপক। মীরা ছিল তার মেয়ের নাম। মারা গেছে সাত বছর আগে। স্ত্রীর মৃতু্যর পর বিশ্বজিৎ ঠিক করেছিলেন মেয়েকে নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু তা আর হলো না। কী এক অজ্ঞাত অসুখে হঠাৎ মীরাও মায়ের কাছে চলে গেল। নতুন করে বিশ্বজিতের আর সংসার পাতা হলো না। ব্যস্ত থাকলেন কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে শিক্ষা দান আর সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশ নিয়ে। শ্রেয়া বিশ্বজিৎ বাবুর ছোট ভাইয়ের মেয়ে। শ্রেয়ার মাঝেই তিনি যেন তার মীরাকে খুঁজে পান। কত বিকাল যে পার করে দিয়েছেন শ্রেয়ার সঙ্গে মীরার পাকামির গল্প বলতে বলতে। শ্রেয়ারও জেদ চাপলো মীরা দিদিকে পাকামিতে হারিয়ে কাকার চোখে মুখে ঘুর লাগাবেই সে।
বিশ্বজিৎ বাবুর একটা কাঁচামি আছে, সবকিছুতেই অবাক হয়ে যাওয়া। শ্রেয়া কাকার এই স্বভাবটাকেই কাজে লাগাতে চাইতো। তাই কাকাকে এমন এক একটা কথা শোনাতো, এমনভাবে কাকার সামনে চালাকি করত, যেন কাকার মুখে দুধ দাঁতই উঠেনি এখনো। ভাতিজির সামনে বিশ্বজিৎ বাবু অবাক হয়ে হা করে থেকেই সময় কাটাতেন।
শ্রেয়া একদিন বাগান বিলাস ফুলের কয়েকটা পাপড়ি হাতে নিয়ে কচলাতে কসলাতে হাত টাকে করে নিল টুকটুকে লাল। কচি তুলতুলে হাতে এই রং হলো যেন আলতা রাঙা। কাকা বাবুর কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, 'জানো কাকা বাবু আজ কী দুর্ঘটনাটা ঘটেছে?'
বিশ্বজিৎ বাবুর চোখে মুখে চিন্তার ছাপ এনে জানতে চাইলেন, 'কী হয়েছে? শিগ্গির বল'।
শ্রেয়া তার রাঙা হাতটা কাপড়ের ভাজ থেকে বের করে কাকার চোখের সামনে ধরে বলে, 'এই দেখো, জবা ফুলের ডাল কাটতে গিয়ে হাতটাকেই কেটে ফেলে ছিলাম। তুমি যদি দেখতে! সে কী রক্ত! ফিনকি দিয়ে ঝরছিল...'
বিশ্বজিৎ সযত্নে শ্রেয়ার হাতটা দেখলেন। শুধু দেখলেনই না, ঘটনাটাও বুঝতে পারলেন। তারপরও মিছে-মিছি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, 'ইস... অনেক কষ্ট পেয়েছিলি বুঝি? রক্তের ছাপ ছাপ দাগ এখনো লেগে আছে দেখছি।'
'কষ্ট তো পেয়েছিলামই। তুমি যদি বুঝতে, সে কী কষ্ট।'
বিশ্বজিৎ বাবু এইবার জিজ্ঞেস করলেন, 'তা পন্ডিত, কাটার ক্ষত চিহ্নটা গেল কোথায়?'
শ্রেয়া বিস্ময়ের ভাব নিয়ে চোখ দুটি বড় বড় করে বলল, 'ওহ, তোমাকে তো বলাই হয়নি। একটা পরির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে আমার। আমাদের ফুল বাগানে মধু খেতে আসে। কাটা হাতটা নিয়ে গিয়েছিলাম তার কাছে। কী এক মন্ত্র বলে ধরল আমার হাতে অমনি ক্ষতচিহ্ন উধাও!' কাচা মুখে পাকা কথাগুলো শুনে বিশ্বজিৎ বাবু হা করে রইলেন ভাতিজির দিকে। 'জানো কাকা? পরিটা না আমাদের দোতলার পূর্ব দিকে ওই যে কালো অন্ধকার ফাটলটা আছে, তার ফাঁকে থাকে। মধু ছাড়া কিছু আর খায় না।'
শ্রেয়ার কাকা বাবু এবার উদ্বেগ প্রকাশ করলেন, 'আমাকে তোর পরি বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দে না।'
'ওরে বাবা! তোমাকে দেখলেই সে প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাবে যে। তুমি পরি দেখবে কেমন করে? পরিরা মানুষের গন্ধ পেলেই প্রজাপতির রূপ ধরে নেয়।'
'যদি লুকিয়ে লুকিয়ে যাই দেখতে?'- শ্রেয়াকে প্রশ্ন করে তার কাকা। শ্রেয়া চোখে মুখে একটা ভীতির ছায়া এনে উত্তর দেয়, 'ওরে সর্বনাশ! এমন কাজ করতে যেও না কোনো দিন। তোমার চোখ দুটি অন্ধ হয়ে যাবে।'
বিশ্বজিৎ চোখ দুটি বড় বড় করে, 'তবে দেখছি ওই কাজটা না করাই ভালো হবে।'
কাকাকে তাক লাগিয়ে দিয়ে শ্রেয়া নিজেকে খুব বড় পন্ডিত মনে করত। আরেকদিন বিশ্বজিৎ ঘোষ সবেমাত্র কলেজ থেকে ফিরেছেন। শ্রেয়া গেল তার কাছে, 'ওহ কী কান্ড একটা ঘটেছে জানো কাকা বাবু?'
'কী ঘটিয়েছিস? না বললে জানব কেমন করে?' কাকা জবাব দিলেন।
শ্রেয়া বলতে শুরু করল, 'শুনো তবে, তুমি তখন সবেমাত্র কলেজে গিয়েছ। ছাদে উঠেছি রোদ পোহানোর জন্য। একটা বিশাল আকৃতির বাজপাখি উড়ে এলো আমার কাছে। বলল আমাকে, এই যে খুকি। যাবে আমার সঙ্গে? আমিও রাজি হয়ে গেলাম। আমাকে নিয়ে সে কী উড়া শুরু। জানো কাকু, একেবারে মেঘের ভেতর দিয়ে সুয্যি মামার দেশে। কী আনন্দ যে লাগছিল! তুমি যদি জানতে!'
বিশ্বজিত বাবু অবাক হয়ে হা করে শ্রেয়ার কথা শুনে। শ্রেয়া তার হাত দুটিকে যতদূর সম্ভব প্রশস্ত করে বলে, 'এত্ত বড় পাখি, বিশাল বিশাল ডানা। আকাশে বেরিয়েছি তার পিঠে চড়ে।'
বিশ্বজিত বাবু চোখ দুটি কপালে তুলে প্রশ্ন করেন, 'ও মা! কী সাহস! যদি হাত ফসকে মাটিতে পড়ে যেতি?'
শ্রেয়া স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দেয়, 'পরে যাব কেন? আমি তো পাখিটার গলায় শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম।'
শ্রেয়ার কাকা কণ্ঠে একটা বিস্ময় এনে বলে, 'মেয়ের সাহস আছে দেখছি! কে বলে তুই বোকা!'
কাকাবাবু চলে গেলে শ্রেয়া তার মুখে হাত চেপে ধরে এক পশলা হেসে নেয়, আর মনে মনে বলে, 'কাকা বাবু কত বোকা! যা বলা যায়, তাই বিশ্বাস করে।'
শিশুশ্রেণির বইয়ে ফুল-পাখি-গাছ-ঘর ইত্যাদি অনেক কিছুর ছবি আঁকা থাকে। শ্রেয়া কার্বন কাগজ দিয়ে একটা বিড়ালের ছবি নকল করে নিয়ে যায় তার কাকার কাছে। ছবিটা ছাপ দিয়ে এঁকেছে, অথচ কাকার কাছ থেকে চিত্রশিল্পী হওয়ার প্রশংসা পেতে চায়, 'দেখতো কাকা বাবু, ছবিটা কেমন এঁকেছি?'
ছবি দেখেন বিশ্বজিৎ বাবু, 'তুই এঁকেছিস? দারুণ হয়েছে তো দেখতে।'
'আরও দারুণ হতে পারতো কাকা বাবু। মায়ের ভয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে এঁকেছি, তাইতো এমন হয়েছে।' বিশ্বজিৎ বাবুর হা করে থাকা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
শ্রেয়া আরেকটা কথা বলে অবাক করত তার কাকাকে- 'কাকাবাবু, আমাদের বাগানে যে একটা দানব বাড়ি আছে দেখেছো কোন দিন?'
বিশ্বজিৎ বাবু কথাটা শুনে চোখদুটিকে করে ফেলতেন হাসির ডিমের মতন, 'না, দেখিনি তো! আমাকে দেখিয়ে দে না একবার। বাড়িটা দেখতে কেমন রে?'
শ্রেয়া বলে, 'ওহ, কী অদ্ভুত সুন্দর! মন্ত্র না জানলে দেখবে কেমন করে?"
বিশ্বজিৎ কাকতি মিনতি করে, 'তাহলে আমাকে মন্ত্রটা শিখিয়ে দে না। আমি তোকে আমার সবুজ কালীর সোনালি কলমটা উপহার দেব।'
শ্রেয়ার উত্তর, 'মন্ত্র শেখাতে মানা আছে। দানব মামার নিষেধ। ওহ বাবা!'
বিশ্বজিৎ ঘোষ শিউরে উঠতেন শ্রেয়ার মুখের ভঙ্গি দেখে। দানব বাড়ি দেখার শখ আর থাকত না। একবার শ্রেয়া বিশ্বজিৎ বাবুকে ধরল, 'কাকা, একটা গল্প বল না।'
বিশ্বজিৎ গল্প শোনালেন। ভীষণ দুর্বুদ্ধ সে গল্প। এই গল্পের অর্থ শ্রেয়া কেন, পৃথিবীর কোনো মানুষই বুঝতে পারবে না! এমনকি বিশ্বজিৎ নিজেও না। কারণ সেটা গল্প ছিল না, কতগুলো শব্দের সমাহার। শ্রেয়া এতক্ষণ গালে হাত রেখে নীরব হয়ে শুনছিল সব। কাকা বাবু প্রশ্ন করলেন, 'বুঝেছিস কিছু?' শ্রেয়া মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল, 'হঁ্যা বুঝেছি।' অথচ মুখ দেখে বোঝা গেল সে গল্পের আগা-পাছা কিছুই বুঝেনি। বুঝেনি তো কী হয়েছে? তাই বলে কি সে বুঝেনি তা কাকাকে বুঝতে দিয়ে নিজেকে মীরা দিদির চেয়ে কম বুদ্ধিমান প্রমাণ করবে নাকি!