দাদিমা

প্রকাশ | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মো. গোলাম মোর্তুজা
.

হেমন্তের রোদ বাড়ির চারদিক ছড়িয়ে পড়েছে। সকালের আবহটা মনমুগ্ধকর হলেও এ বাড়ির সবাই মন খারাপের মেঘে ঢেকে আছে। দাদিমার অসুখ করেছে। হাসনাত এ বাড়ির একমাত্র ছোট। ছোট বললেও ছোট না ও এবার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। দাদিমার সঙ্গ ওকে জাদুর মতো টানে। দাদিমার অসুখ বা কোনো কারণে মন খারাপ থাকলে হাসনাত ফালাফালা হয়ে যায়। কদিন থেকেই দাদিমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মোলাকাত এ বাড়ির কর্তা। দাদিমার একমাত্র ছেলে। মাসের শেষ। মা অসুস্থ। অসুখ তো আর এসব বোঝে না। মায়ের অবস্থা ভালো ঠেকছে না। ঝরঝরে বালি যেমন মুষ্টিবদ্ধ করে রাখলেও ধরে রাখা যায় না তেমনি মাকেও মনে হয় এবার আর ধরে রাখা যাবে না। মোলাকাত মলিনবদনে সংশয়াকুল দৃষ্টিতে মাকে দেখে। সকাল হয়েছে অনেক আগেই। মোলাকাত যেন নিজেকে খুঁজে পাচ্ছেন না, অভাব নামক বাঘের খপ্পরে পড়ে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছেন। নিজের সবটুকু দিয়ে মোলাকাত মায়ের চিকিৎসা সোৎসাহে করাতে চান। এক পা-দু'পা করে মায়ের ঘরে গেলেন মোলাকাত। বললেন, 'মা, শরীরটা কী বেশি খারাপ? বিকালে তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব'। ছেলের অবস্থা মা-সুজলা বোঝেন। বলেন, 'আমি ভালো আছি বাবা, ডাক্তারের কাছে গেলে একগাদা টেস্ট দেবে। অনেক টাকা খরচ হবে। থাক বাবা ওসব দরকার নেই।' মায়ের কথার অর্থ বোঝেন মোলাকাত। সেবার মৃতু্যর সঙ্গে সুজলার আলাপ-পরিচয় বেশ ভালোই হয়েছিল। কটা দিন পর সুজলার শরীরটা অসম্ভব রকমের খারাপ হয়- যেন গাছের শুকনো পাতা একটু টোকা লাগলেই ঝরবে। মোলাকাত জেনে গেছে গাছের ফুল ফসল সব শেষ যে কোনো সময় গাছটিই মরে যেতে পারে। তবে আরেকবার ডাক্তার দেখাতে পারলে মনের প্রশান্তি আসত। কিন্তু টাকা নেই। একতলা স্কুলের একমাত্র বিজ্ঞানের শিক্ষক। \হসব নিস্তব্ধ করতে রাত এলো। রাতে সবাই ঘুমালেও মোলাকাত ঘুমোতে পারেনি। বরান্দায় বাবার পায়চারি দেখে হাসনাত বুঝেছে বাবার মনে হতাশারা টহল দিচ্ছে। ছোট মানুষ হাসনাত বাবার সঙ্গে রয়েছে একগাল হাসির সম্পর্ক। কিন্তু দাদিমার অসুখ বাড়ার পরপর বাবাকে যেন সে কাছেই পায় না। পাওয়ারও কথা নয়। বাবাকে কাছে পাওয়ার প্রত্যাশা একদিকে আরেক দিকে বাবার সঙ্গে ওর বিশেষ প্রয়োজন। বাবার কাছে যাওয়ার রাস্তায় ও দৌড় দিল। বাবার কাছে গিয়ে হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, 'বাবা এই নাও। দাদিমাকে নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে যাও।' ছেলের এমন আচরণে বাবা হয়ে কী করা উচিত তা ভেবেও পান না। দু'হাত প্রসারিত করে ছেলেকে আদর করতে করতে মোলাকাত বললেন, 'টাকা কোথায় পেলে বাবা?' বাবার আবেগবিজড়িত কথা শুনে হাসনাত বিড়বিড় করে বলল, 'বাবা আমাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য যে টাকা দিতে তা থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। দেখলে তো এখন কাজে লাগল।' বাবার মুখ মলিন- বাবাকে প্রাণবন্ত ও স্বাভাবিক করবার জন্য হাসনাত বলল, 'মনে কর না এ টাকা এমনি তোমাকে দিলাম। ধার দিলাম কিন্তু। সময় বুঝে পরিশোধ করিও।' মোলাকাত নিজেকে অপ্রতিভ নীলিমার মতো ভাবছে; এমন সন্তান এ দেশেতে আছে। মোলাকাতও তো চোখের কোণে অব্যক্ত বেদনার খচখচে বালি চোখটাকে নাজেহাল করে ছাড়ছে। শাহানাজ ঘুমের ঘোরেই বললেন, 'কী রে এখনো কোথায়, ঘুমোতে আয় হাসন।' হাসনাত মায়ের ডাকে কোনো সাড়া দিল না। খাসিকাটা নাম হাসনাত আর মা ডাকেন হাসন বলে; হাসন নামটা হাসনাতের ভালো লাগে না। অল্পকিছুক্ষণের জন্য সেখানে বাতাসহীন প্রকৃতি যেমন ভাবনাহীন নিস্তব্ধতার মূর্তি হয়ে থাকে। তেমনি এক ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়েই থাকল বাবা ও ছেলে। হঠাৎ শান্ত পরিবেশে বজ্রপাত হলো। মা এলেন। হাসনাত মাকে দেখেই বুঝেছে, এবার হয় কান মলা, নয় পটাশ করে একটা থাপ্পড় খাবে এবং তা হজমও করতে হবে ওকে। কারণ অনেক রাত হয়েছে। তারপর সকালে ওঠে স্কুলে যেতে হবে। সে কাজ শাহানাজই করেন। মাকে দেখে হাসনাত মায়ের দিকে যাওয়া শুরু করল, ওকে দেখে মনে হয় ও নিষ্পাপ এক বালক মায়ের কাছে ঘুমোতে যায়নি সেটা ওর বাবার জন্য। মায়ের মুখোমুখি হাসনাত। মা কোনো কান মলা বা জোরে থাপ্পড়ও মারলো না। মায়ের এ রকম পরিবর্তনে হাসনাত খুশি- তবে যে কোনো মুহূর্তে তা আবার ঝড়োবৃষ্টি হয়ে অবিরাম কয়েকবার পড়তেও পারে। হাসনাত বলল, 'মা আমি যাচ্ছিলাম তোমার কাছে হঠাৎ বাবা...। হাসনাতের কথা মাছরাঙা যেমন জলের মাছকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় ঠিক তেমন করে কেড়ে নিল। হাসনাতের হাত ধরল। হাসনাত এবার কাবু হয়ে গেছে, বোবার মতো গোঙাছে। তবে সেটা মনে মনে। মন থেকে তা বেরুবার সাহস পেল না। মোলাকাত সাহেব ছেলেকে মায়ের হাত থেকে বাঁচাতে তৎপর হলেন। এ বয়সে এমন একটা প্রকৃতির মতো পবিত্র ও ভাবুক সরল মনা ছেলেকে মারা নয় বরং কোলে কোলেই রাখা উচিত। মোলাকাত বললেন, 'ছেলেকে মেরো না। আজ ও এমনা একটা কাজ করেছে- যা শুনলে ছেলেকে নিয়ে গর্ব করবে।' মোলাকাত সাহেবের কথায় শাহানাজ কোনো তাপ অনুভব করলেন না বরং মনে হলো ছেলে হাসনকে নিয়ে ফড়ফড় করে শোবার ঘরে যেতে পারলেই ভালো হয়। মায়ের গতি তাক্‌ করে আছে হাসনাত। বলল, 'দাদিমাকে একা রেখেই চলে এলে। অসুস্থ মানুষকে একা রাখতে নেই।' বলেই কিছু একটা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য যেমন মানুষ দৌড়ায় ঠিক তেমনভাবে হাসনাত দৌড়াল। দাদিমা বিছানায় যেন মৃতের মতো পড়ে আছে। দাদিমাও গুটিসুটি মেরে আছেন। হাসনাত দাদিমার পাশে মলিন বিছানাতে বসল। বলল, 'দাদিমা, একটুও চিন্তা করো না। বাবা তোমাকে কালকে আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। দাদিমা ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, 'দাদা ভাইরে আর ডাক্তার দেখিয়ে অযথা টাকা খরচ করে কী আর হবে। হয়তো ওপারের ডাক এসেছে- চলে যেতে হবে।' দাদিমার কথা শেষ হতে না হতে হাসনাতের চোখ বেয়ে টপটপ করে মায়াই ঘেরা জল ঝরল। হাসনাত ঘর ছেড়ে দরজার ওপাশে ঠেশ লেগে নীরবে চোখ মুছছে। সব চুপচাপ। রাতের ডিম লাইটের বিচিত্র আলোয় হাসনাতকে না পেয়ে দাদিমা ডাকলেন, 'কইগো আমার দাদাভাই। শুনে যাও। একটা গল্প বলব খুব মজার।' হাসনাত রাক্ষসের গল্প পছন্দ করে। দাদিমার গল্প শোনানোর কথা শুনে দরজার ওপার থেকেই বলল, 'দাদিমা মরে যাওয়ার কথা আর কোনো দিন বলবে না। তোমাকে মরতে দেব না। আমার জন্যই তোমাকে বাঁচতে হবে। আমি বড় হয়ে তোমাকে বিদেশে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।' হাসনাতের চোখের কোণে জল চকচক করছে। দাদিমা তন্দ্রালু চোখে হাসনাতকে দেখল। বলল, 'আমার জাদু সোনার কথা শোনো। আলস্নাহ তোমাকে হায়াত দারাজ করুক। আসো, দাদাভাই গল্পটা শোনাই।' গল্প বলতে বলতে খুকখুক করে কাশলেন। ইতোমধ্যে মোলাকাত ও শাহানাজও এসেছেন। কাশির অবাধ্য রকমের বাড়াবাড়ি দেখে ছেলে মোলাকাতের বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যায়। বললেন, 'মা, কাশিটা বেড়েছে? কাল আবার ডাক্তারের কাছে যাব। রেডি থেক।' বলেই শোবার ঘরে চলে গেলেন। শাহানাজও ছেলেকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। হাসনাতের টাকায় দাদিমাকে ডাক্তার দেখানো হলো। সাত দিনের মাথাতে দাদিমা বেশ সুস্থ। দাদিমার সুস্থতাই যেন হাসনাতকে সুখের সুরেলা ছন্দে দোলায়িত করে তুলেছে।