শরতের উপহার শিউলি ফুল

শিউলি ফুল রাতে ফুটে বলে একে রাতের রানিও বলা হয়। আবার সকাল হওয়ার আগেই ফুল ঝরে যায় বলে শিউলি গাছকে বিষণ্ন্ন বৃক্ষও বলা হয়। চিরাচরিত গ্রাম-বাংলায় শিউলি একটি ভালো লাগার নাম। আবহমান কাল ধরে শরৎ ও হেমন্তের সঙ্গে শিউলি ফুলও মানুষের মনে জায়গা করে আছে নবান্নের মতই আনন্দ ও ভালো লাগার অংশ হয়ে

প্রকাশ | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

নূরজাহান নীরা
শিউলি ফুল
শ রৎ মানেই শিউলি ফুলের আগমন। শরৎ মানেই শিউলি ফুলের সমাহার। বর্ষার সৌন্দর্যকে সঙ্গে নিয়েই ঋতু বৈচিত্র্যের ধারায় আমাদের মাঝে উপস্থিত হয় ঋতুরানি শরৎকাল। ঋতুরানি শরতের একটি শ্রেষ্ঠ উপহার শিউলি ফুল। ছোটো ছোটো কমলা আর সাদা রঙের মিশ্রণে এ ফুল অসম্ভব সুন্দর লাগে দেখতে। শিশির ভেজা পথে বা সবুজ ঘাসের গালিচায় ঝরে পড়া কমলা সাদার এই শিউলি ফুলের সৌন্দর্যে চোখ আটকে যাবে প্রতিটি মানুষেরই। কুয়াশা জড়ানো ঝিরিঝিরি শীতল বাতাস এই ফুলের মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে দেয় চারিদিকে। শিউলি ফুল সন্ধ্যা থেকে ফুটতে শুরু করে এবং সকাল হওয়ার আগেই ঝরে যায়। শিউলি ফুল রাতে ফুটে বলে একে রাতের রানিও বলা হয়। আবার সকাল হওয়ার আগেই ফুল ঝরে যায় বলে শিউলি গাছকে বিষণ্ন্ন বৃক্ষও বলা হয়। চিরাচরিত গ্রাম-বাংলায় শিউলি একটি ভালো লাগার নাম। আবহমান কাল ধরে শরৎ ও হেমন্তের সঙ্গে শিউলি ফুলও মানুষের মনে জায়গা করে আছে নবান্নের মতই আনন্দ ও ভালো লাগার অংশ হয়ে। ভালো লাগার ভালোবাসার সে আবেগ থেকেই শিল্পী গেয়েছেন- শিউলি ফুলের মালা গেঁথে কারে পরাব, কারে আমি এ ব্যথা জানাব। শরতের উপহার এই শিউলি ফুল বাংলা সাহিত্যের অনেকটা অংশজুড়ে আছে। শিউলি ফুলের রূপে মুগ্ধ হয়ে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শিউলি ফুলকে তার লেখায় এভাবেই তুলে ধরেছেন- শিউলি ফুলের মালা দোলে/শারদ-রাতের বুকে ওই। এমন রাতে একলা জাগি/সাথে জাগার সাথি কই।'? তিনি আরও লিখেছেন, শিউলি তলায় ভোরবেলায় কুসুম কুড়ায় পলস্নী-বালা। শিউলি না ফুটলে শরতের শুভ্রতা যেন অপূর্ণই থেকে যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মুগ্ধ হয়েছিলেন এই শিউলির রূপে। তিনি লিখেছিলেন, শিউলি ফুল শিউলি ফুল, কেমন ভুল এমন ভুল/রাতের বায় কোন মায়ায় নিল হায় বনছায়ায়। তিনি আরও লিখেছেন, আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা/নবীন ধানের মঞ্জরি দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা। শিউলি ফুলকে নিয়ে এমন অজস্র পঙক্তি বাংলা সাহিত্যকেও সুবাসিত করে রেখেছে ফুলের মতই। শিউলি ফুলের আরও নাম আছে। যেমন- শেফালি, শেফালিকা,পারিজাত। শিউলি ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম ঘুপঃধহঃযবং ধৎনড়ৎ-ঃৎরংঃরং. এটি হচ্ছে নিক্টান্থেস (ঘুপঃধহঃযবং) প্রজাতির একটি ফুল। এটি দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড থেকে পশ্চিমে বাংলাদেশ, ভারত, উত্তরে নেপাল, ও পূর্বে পাকিস্তান পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। এই ফুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যফুল ও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের প্রাদেশিক ফুল। শিউলি গাছের বাকল বা চাল নরম ও ধূসর বর্ণের হয়। এই গাছ ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছের পাতাগুলো ৬-৭ সেন্টিমিটার লম্বা ও সমান্তরাল। পাতাগুলো গাঢ় সবুজ এবং খসখসে হয়। এই ফুলে রয়েছে পাঁচ থেকে সাতটি সাদা বৃত্তি এবং মাঝে লালচে-কমলা টিউবের মতো বৃন্ত। এই কমলা অংশ দিয়ে গ্রামের শিশু-কিশোর ছবিতে রঙের ছাপ দেয়। মালা গেঁথে পরে। পুতুলের গলায় পরায়। মেয়েরাও খোঁপায় পরে। ভোর হলেই তারা ছুটে যায় শিউলি তলায়। এর ফল চ্যাপ্টা ও বাদামি দেখতে হৃৎপিন্ডাকৃতির। ফলের ব্যাস ২ সেন্টিমিটার এবং এটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগে একটি করে বীজ থাকে। শরৎ ও হেমন্ত ঋতুতে শিউলি ফুটে। শীত এলেই গাছের পাতা ঝরে যায়। এই ফুল হলুদ রঙ তৈরি করতেও ব্যবহার করা যায়। ফুলের বোঁটাগুলো শুকিয়ে গুড়ো করে সেই গুড়ো পাউডার হালকা গরম পানিতে মেশালে চমৎকার রঙ হয়। শিউলি ফুলের যেমন আছে মিষ্টি গন্ধ আর মন ভালো করে দেওয়ার মতো রঙের মিশ্রণ, তেমনি আছে এর বেশ কিছু ঔষধি গুণও। খালি পেটে শিউলি গাছের পাতার রস খেলে কফের সমস্যা দূর হবে। যদিও এর রস অত্যন্ত তেতো কিন্তু এটি নিয়মিত খেলে কাশি ও কফ দুটোই দূর হবে। সাইটিকার ব্যথা কমাতে শিউলি পাতার রস বেশ কার্যকর। কয়েকটি শিউলি পাতা ও কয়েকটি তুলসি পাতা এক সঙ্গে পানিতে ফুটিয়ে নিয়মিত কয়েক সপ্তাহ খেলে এই ব্যথা দূর হবে। জ্বর কমাতে সাহায্য করে শিউলি। দীর্ঘস্থায়ী জ্বর কমাতে শিউলির চা পান করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। ম্যালেরিয়ার সময় শিউলি পাতা বাটা খেলে এই রোগের উপসর্গগুলো কমতে শুরু করে। ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইটগুলো নষ্ট হয়, রক্তে পস্নাটিলেটের সংখ্যা বাড়ে। আমাদের ত্বকের জন্যও শিউলির উপকারিতা অনেক। এতে আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটারি গুণ। এটি মুখের ব্রণ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। শিউলির তেলের ব্যবহার মাথার চুল বাড়াতে সহযোগিতা করে। গলার আওয়াজ বসে গেলে ২ চামচ শিউলি পাতার রস গরম করে দিনে দু'বার কয়েকদিন খেলে উপকার পাওয়া যাবে।