শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

ভূতোর বন্ধু নিরু মামা

আশরাফ আলী চারু
  ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ভূতোর বন্ধু নিরু মামা

ক'দিন থেকে নিরু মামা খুব নীরব হয়ে গেছে। খাওয়া-নাওয়া ভুলে সব সময় ঘরের ভেতর কী যেন করে। ঘরের ভেতর থেকে লক করা থাকে বলে কেউ ঢুকবে এমন সুযোগও নেই। সাকিবের মা যিনি নিরু মামার একমাত্র বোন ও অভিভাবক তার ডাকেও সে ঘরের দরজা খোলে না। একটু আধটু সাড়া দেয় এর বেশি কিছু নয়। লোকটা ঘরে এত সময় কীভাবে থাকে? ক্ষুধা লাগলে কী খায়? সাকিবরা মামাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছে। যে নিরু মামা গাঁয়ের সব ভাগিনাকে মাতিয়ে রাখে সেই নিরু মামার নীরবতায় চিন্তিত না হয়ে পারা যায়? কী হলো নিরু মামার?

বাইরে দাঁড়িয়ে সাকিবরা এসব নিয়ে বলাবলি করছিল। হঠাৎ নিরু মামার ঘর থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো। উচ্চ শব্দের সেই হাসির আওয়াজ। সেই সঙ্গে কিছু কথাও শোনা গেল। নিরু মামার কথা শুনে সাকিবরা কিছুটা শান্তি অনুভব করল। কিন্তু না, পরের কথাতেই সেই শান্তি উবে গেল।

-আমি বলেছি তো, হঁ্যা হ্যাঁ, গারো পাহাড়টা তোমার। আর তোমার পাহাড়ের আমি সেনাপতি। সবাইকে দেখে ছাড়ব। কোনো চিন্তা করো না...

সাকিব জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে উঁকি দিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করল। কিছু দেখতে না পেয়ে আরও হকচকিয়ে গেল। সাকিবের বন্ধুরা একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল।

কদিন থেকে নীরব থাকা নিরু মামা আজ যে পাগলের প্রলাপ শুরু করেছে! না-কি ভূতের আছড় পড়ল মামার ওপর? সাকিবের এমন ভাবনা শেষ না হতেই নিরু মামা বলে উঠল- সাকিব, তোর ভূত নিয়ে চিন্তা করা কোনো দরকার নেই। তোর কাজ তুই কর। তোরা স্কুলে যাবি যা। এখানে কাউকে যেন আর না দেখি। কারুর ফিসফাস যেন না শুনি। তোরা কেউ আমি আর আমার ভূতো বন্ধুর পিছনে লাগতে আসিস না। তাইলে কিন্তু তোদের পরিণাম...

ওরে বা বা রে বলে পড়িমরি করে সাকিবের বন্ধুরা দৌড় দিল। এক দৌড়ে তারা স্কুলে চলে গেল। সাকিব গেল না। সে ভাবতে লাগল মামা তার মনের কথা জানল কেমন করে! যখনই ভূতের কথা মনে মনে ভাবলাম তখনই মামা কত সব কথা বলে ফেলল! সত্যিই মামাকে ভূতে ধরেছে। মাকে বিষয়টি বলতে হবে। ভয়ে গুটিসুটি মেরে মাকে ডাকতে লাগল সাকিব। মা, মা নিরু মামাকে নিশ্চিত ভূ উ উ তে ধ রে ছে, এই বলে কোনোমতো ঢুক গিলল সাকিব। সাকিবের মা সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল। হঁ্যা গো এখন কি হবে গো। আমার একমাত্র ভাই। মা মরা ভাই, এতিম ভাই, এখন কি হবে গো বলে গড়াগড়ি করে কাঁদতে লাগল।

গত দুই সপ্তাহে গাঁয়ের সবাই জেনে গেছে নিরু মামাকে ভূতে ধরেছে। আধা ডজন ভূত ছাড়ানোর ওঝা এসে ভূত ছাড়াতে ফেল মেরেছে। কারুর দ্বারাই এত বড় ভূত ছাড়ানো সম্ভব হয়নি। আজ একজন ওঝা চ্যালেঞ্জ করে এসে বলল, পৃথিবীর যত নিকৃষ্ট ভূতই হোক, যত শক্তিশালী ভূতই হোক আজ তিনি ছাড়িয়ে দেখাবেন।

রাতে সারা গাঁয়ের লোক উঠানে জড়ো হলো। উত্তর মুখো হয়ে ওঝা বসলেন। এই গরমে চাদর গায়ে দিয়ে নিরু মামা এসে বসল দক্ষিণ মুখো হয়ে। নিরু মামাকে এখানে আসার জন্য কারুর সাহায্য নিতে হলো না। তাকে একাকি এসে বসতে দেখে উপস্থিত লোকজন ওঝার কারিশমা আছে বলে আলোচনা করল।

এবার নিরু মামা মুখ খুলল, বলো, ওঝা কি জানতে চাও?

-আমার রোগীটাকে ছেড়ে দিতে হবে। সে খুব ভালো মানুষ। আজ তিন সপ্তাহ থেকে সে তোকে নিয়ে কাটাচ্ছে। কত ওঝা এলো আর গেল তবু ছাড়লি না। আজ তোকে চলে যেতে হবে। নতুবা তোকে বোতলে বন্দি করে রাখব।

-হা হা হা হা হা। হাসিতে সারা উঠান মাতিয়ে তুলল নিরু মামা। ওঝা সাহেব, আমাকে ভূতে ধরেছে? গত এক সপ্তাহ থেকে আমার বোনটার কাছে তোমরা ফাও টাকা নিচ্ছ। ভূতে ধরে তাই না? জোচ্চোরের দল আজ তোকে এমন শিক্ষা দেব যেন জীবনে এই জোচ্চুরি কাজ না করিস। বলে নিরু মামা কিল-ঘুষি দিয়ে ওঝাকে দৌড়ানি দিল। উপস্থিত লোকজন ভয় পেয়ে গেল। তাদের ধারণা হলো নিরুকে সত্যিই বড় ভূতে ধরেছে। আরও বেশি জানাশোনা ওঝা আনতে হবে। এবার নিরু মামা সবাইকে তাক লাগিয়ে বলতে লাগল- শুনেন, সপ্তাহ তিনেক আগে আমি গারো পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে একটা ময়নার ছানা কুড়িয়ে পেয়েছি। এত ছোট ছিল যে তার লোম গজায়নি। দেখতে ভূতের ছানার মতো লাগছিল বলে ভূতো নাম দিয়ে তাকে এই কয়দিন ধরে ঘরে থেকে লালনপালন করে বড় করলাম। সে এখন কথা বলার জন্য কান পেতে শুনে।

এবার সাকিব বলল, তবে ঘর ভেতর থেকে লক করে রাখতে কেন? আর এই কয়দিনই বা এই কথা বলনি কেন?

-যদি বলতাম, তোদের অত্যচারে পাখিটিকে মানুষ করতে পারতাম। তোরা তো আউলাঝাউলা করে দিতি। কান পেতে শোন আমি ডাক দিলে সে চিচি করে কথা বলবে। বলে সে ভূতো বলে ডাক দিতেই ঘর থেকে চিচি আওয়াজ এলো। সবাই শুনল।

-তুমি তবে কেন বলেছিলে গারো পাহাড়ের সেনাপতি তুমি?

-আরে গাধা, ছানাটিকে বুঝ দেওয়ার জন্য। আরেকটু বড় হলে তাকে পাহাড়ে ছেড়ে দিয়ে আমি সেনাপতিগিরি করব যাতে তার কোনো ক্ষতি না হয়।

-আমি মনে মনে ভূত ভাবার সময় তুমি কেমনে বললে যে ভূতের কথা যেন আমি না ভাবি।

-আমি জানি ও রকম পরিস্থিতির সময় সবাই ভূতে ধরার ভাবনায় মশগুল থাকে। আমি এজন্যই বলেছিলাম। তাছাড়া ওই কথা না বললে তোরা কেউ আমার ঘরের আঙিনা ছাড়তি না।

-তুমি এই কয়দিন ঘরে আবদ্ধ থেকে খেলে কী?

-আরে বোকা, চিড়ামুড়ি। ঘরের ভেতর যখন সব সুবিধা থাকে তখন বের না হলেই কী।

এরপর উপস্থিত সবাইকে নিরু মামা বলল, ভূতের বন্ধু তোমাদের এই নিরু মামা। তাকে ভূতে ধরবে এমন ভূত দুনিয়াতে আছে না-কি!

নিরু মামার কথা শুনে সবাই আশ্বস্ত হলো যে নিরু মামাকে আসলেই ভূতে ধরেনি। এরপর সবাই যার যার বাড়িতে চলে গেল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে