বর্ষায় কদমফুল

প্রকাশ | ০৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

নূরজাহান নীরা
ষড়ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আমাদের এই দেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সম্পদে ভরপুর। এখানে ছয়টি ঋতু আমাদের মাঝে হাজির হয় ছয়টি অপরূপ রূপের ডালি নিয়ে। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা এই বদ্বীপ ভূমির একটি ঋতু হচ্ছে বর্ষা। অন্য ঋতুর মতো হাজারও সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয় এই বর্ষা ঋতু। আর বর্ষা ঋতু মনে পড়তেই যে ফুলটির নাম সবার আগে মনে পড়ে তা হলো কদমফুল। আবহমান গ্রাম বাংলার চিরাচরিত রূপ যেন স্বমহিমায় স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে জানান দেয় এই কদম গাছ। এমন কোনো মানুষ পাওয়া যাবে না যে, এই কদমফুল পছন্দ করে না। শিশু থেকে বৃদ্ধ এমন কোনো মানুষ নেই যে বৃষ্টির ছন্দের সঙ্গে কদমফুলের এ দোল পছন্দ করে না। মৃদু বাতাসে কদমের এ দোল সবার মনকে একটু হলেও নাড়িয়ে যায়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি জড়ানো বাতাসের সঙ্গে কদমফুলের মিষ্টি সুবাস মনকে সজীব করে তোলে। অন্য সব ফুলের চেয়ে ভিন্ন সৌন্দর্য বহন করে এ ফুল। হলুদ পাখির গায়ে সাদা পালক যেন। বর্ষাকাল আর কদমফুলের সম্পর্ক যেন চিরন্তন। কদমফুলকে তাই বর্ষার দূতও বলা হয়। এ সময়ে আম, কাঁঠাল ও জাম ইত্যাদি ফলের সমাহার থাকে। চারদিকে থৈ থৈ পানি। নদী-নালা,খাল-বিল নতুন সাজে সেজে ওঠে। এর মাঝেও কদমফুল মানুষের মনকে আকৃষ্ট করে ধরে রাখে তার নিজস্বতায়। সবুজ পাতার গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে যেতে চায় তারাও। সবুজ ঘন পাতার ফাঁক গলে টুপটাপ বৃষ্টিতে মিশে আসে কদমফুলের মিষ্টি গন্ধ। এ সময় মানুষের হাতে হাতে দেখা মেলে কদমফুল। ছোট্ট বাচ্চারা ফুলের মঞ্জুরি খসিয়ে তা দিয়ে দিনভর খেলা করে। বর্ষা, কদমফুল আর রঙিন ছেলেবেলা একই সূত্রে গাঁথা যেন। কদমফুল শুধু সৌন্দর্যে মন কাড়ে তা নয়। এর আছে অনেক ঔষধি গুণও। কদম গাছের ছাল জ্বর নাশক ও বলকারক হিসেবে বেশ কাজ করে। কৃমি দূর করতে কদম পাতার রস বা শুকনো কদমপাতার গুড়ো বেশ কার্যকরী। রস ব্যবহারে অবশ্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় এ জন্য গুড়োটা ব্যবহারে পরামর্শ দেন আয়ুর্বেদ চিকিৎসকরা। ক্ষত বা ঘা সারাতেও কদমফুল কুচিয়ে তা সিদ্ধ করে সে পানি কুলকুচি করলে বেশ উপকার পাওয়া যায়। বিশেষ করে ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষতে। এছাড়াও ব্যথা, ম্যালেরিয়া বা মুখের দুর্গন্ধে কদমপাতার রস বেশ কাজে লাগে। তদানীন্তন যুগের সার্জেন ডা. আনন্দমোহন মুখার্জি লিখেছেন, শিশুদের মুখের ঘায়ে ও স্টোমাটাইটিসে কদমপাতা সিদ্ধ পানি মুখে ধরে রাখলে বা কুলকুচি করলে দ্রম্নত তা সেরে যায়। এত গুণ আর রূপে ভরপুর এ কদমগাছের আদি নিবাস বাংলাদেশ, ভারতের উষ্ণ অঞ্চল, চীন ও মালয়। কদমগাছ খুব দ্রম্নত বাড়ে। প্রায় চলিস্নশ মিটার লম্বা হতে পারে এ গাছ। দীর্ঘাকৃতি, বহুশাখাবিশিষ্ট বিশাল বৃক্ষ বিশেষ এটি। কদমের কান্ড সরল, উন্নত, ধূসর থেকে প্রায় কালো। শাখা অজস্র এবং ভূমির সমান্তরালে প্রসারিত। পাতা হয় বড় বড়, ডিম্বাকৃতি, উজ্জ্বল-সবুজ, তেল-চকচকে এবং বিন্যাসে বিপ্রতীপ। উপপত্রিকা অত্যন্ত স্বল্পস্থায়ী বিধায় পরিণত পাতা অনুপপত্রিক। বোঁটা খুবই ছোট। নিবিড় পত্রবিন্যাসের জন্য কদম ছায়াঘন। শীতে কদমের পাতা ঝরে এবং বসন্তে কচি পাতা গজায়। সাধারণত পরিণত পাতা অপেক্ষা কচিপাতা অনেকটা বড়। কদমের কচি পাতার রঙ হালকা সবুজ। কদমের একটি পূর্ণ মঞ্জরিকে সাধারণত একটি ফুল বলেই মনে হয়। কদম ফুল দেখতে বলের মতো গোল, মাংসল পুষ্পাধারে অজস্র সরু সরু ফুলের বিকীর্ণ বিন্যাস। পূর্ণ প্রস্ফুটিত মঞ্জরির রঙ সাদা-হলুদে মেশানো হলেও হলুদ-সাদার আধিক্যে প্রচ্ছন্ন। প্রতিটি ফুল খুবই ছোট, বৃতি সাদা, দল হলুদ, পরাগচক্র সাদা এবং বহির্মুখীন, গর্ভদন্ড দীর্ঘ। ফল মাংসল ও টক। কদমফুল পেকে গেলে তা বাদুড় ও কাঠবিড়ালীর প্রিয় খাদ্য হয়। বাদুড় এবং কাঠবিড়ালির মাধ্যমে এর বীজ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং গাছ জন্মায়। কদম ছাড়াও এর আরও অনেক নাম আছে। কদম বা বুল কদম (বৈজ্ঞানিক নাম : অহঃযড়পবঢ়যধষঁং রহফরপঁং)। জঁনরধপবধব পরিবারের ঘবড়ষধসধৎপশরধ গণের বৃক্ষ। যা নীপ নামেও পরিচিত। এ ছাড়া বৃত্তপুষ্প, মেঘাগমপ্রিয়, কর্ণপূরক, ভৃঙ্গবলস্নভ, মঞ্জুকেশিনী, পুলকি, সর্ষপ, প্রাবৃষ্য, ললনাপ্রিয়, সুরভি, সিন্ধুপুষ্প নামেও পরিচিত।