মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১
গল্প

টিয়ে পাখির ঠোঁটটি লাল

সাগর আহমেদ
  ১৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
টিয়ে পাখির ঠোঁটটি লাল

সেই বছর বৈশাখের শুরুতেই ভোর রাতে একটা প্রচন্ড ঝড় বয়ে গেল। ঝড়ের তান্ডবে রিপাদের বাসার উঠোনের বাম পাশে থাকা প্রকান্ড বটগাছের বড় আকৃতির একটা ডাল শাখা-প্রশাখাসহ ভেঙে মাটিতে পড়ল। সেই ডালেই ছিল এক টিয়ে দম্পতির বাসা। ডালটা এমনভাবে পড়েছিল যে, বাসাসহ টিয়ে দুটি একেবারে থেঁতলে গিয়ে মারা পড়ল। টিয়ে জুটির ছিল তিনটে বাচ্চা। বাচ্চাগুলো কিন্তু মরলো না। ওরা গাছটা থেকে কিছুটা দূরে মুমূর্ষু অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রইল। রিপা আর ওর বোন রাশ্মি ভোরের আলো ফুটতেই বের হলো বৈশাখী ঝড়ের তান্ডবে আমগাছ তলা থেকে আম কুড়াতে। ওরা দুই বোন মিলে কোচর ভরে আম কুড়িয়ে বটগাছের ভাঙা ডালটিতে এসে বসলো। হঠাৎ রাশ্মি রিপাকে বলল, 'দেখ আপু, এক জোড়া টিয়ে পাখি মরে পড়ে আছে।' রিপা তাকিয়ে দেখলো শুধু মরা টিয়ে দুটি নয়, তিনটি টিয়ের বাচ্চাও আহত অবস্থায় পড়ে আছে। তারা দুইবোন টিয়ের বাচ্চা তিনটিকে একটা পাতলা কাপড়ে জড়িয়ে বাসায় নিয়ে এলো। তারপর যত্ন আদর, সেবা, শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুলল। প্রতিদিন স্কুলের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে টিয়েদের জন্য কিনে আনতে লাগল বিভিন্ন শষ্য বীজ, কলা, সূর্যমুখী বীজ এবং আরো অনেক কিছু। রিপা ও রাশ্মির আদর যত্নে টিয়ে তিনটি দ্রম্নত বড় হতে লাগল। দুই বোন মিলে ছেলে টিয়ে দুটির নাম রাখলো মিঠু ও টিটু। আর মেয়ে টিয়েটির নাম রাখা হলো মন্টি। ধীরে ধীরে টিয়েগুলোর নরম সবুজ পালক গজালো। ওদের ঠোটগুলো ছিল সে যুগের অন্য সব টিয়ে পাখির মতোই কালো। এর মধ্যে মিঠু বেশ স্বাস্থ্যবান, টিটু কিছুটা রোগাটে ও হালকা, পাতলা, আর মন্টি দেখতে অনেক সুন্দর। রিপা ও রাশ্মি ওদের ছড়া বলতে শিখালো। বিশেষ করে মিঠু খুব সুন্দর করে চেঁচিয়ে উঠে ছড়া বলত :

ওপেন্টি বায়াস্কোপ

নাইন টেন টেসকোপ

সুলতানা বিবিয়ানা

সাহেব বাবুর বৈঠকখানা...

আশপাশের বাড়ির অনেক শিশু-কিশোর মিঠুর ছড়া শোনার জন্য রিপাদের বাড়িতে ভিড় জমাতো। মিঠু, টিটু ও মন্টি সারা গ্রামজুড়ে উড়ে বেড়াত আর মজা করত। সন্ধ্যে হলে বাসায় ফিরে আসতো। বাসায় এলেই রাশ্মি ওদের আদর যত্ন করে খেতে দিত। এভাবে ভালোই চলছিল সবকিছু। ধীরে ধীরে তিনটি টিয়ের ছানা যৌবনে পদার্পণ করল। এখন দেখা গেল মন্টি কখনো টিটুর সঙ্গে গাছের ডালে বসে আছে, তখন কিছুটা দূরে মিঠু মন খারাপ করে বসে আছে। আবার কখনো দেখা যায় উল্টোটা। এভাবেই মন্টিকে নিয়ে টিটু, মিঠুর মধ্যে বাড়তে থাকে নীরব দ্বন্দ্ব। মিঠু আর টিটুর মধ্যে শৈশব আর কৈশোরের দুরন্ত ভালোবাসা ফিকে হয়ে আসে। একদিন মিঠু আর টিটু গ্রামের পাশের বনে উড়ে উড়ে খাবার খুঁজছিল। একটু নির্জনে আসতেই, অকস্মাৎ মিঠু টিটুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার ধারালো ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে তাকে রক্তাক্ত করে দিল। টিটু ব্যথায় আর্তনাদ করে কিছু একটা বলতে চাইল। কিন্তু তার আগেই টিটুর জীবন প্রদীপ নিভে গেল। মারা গেল টিটু। টিটুর রক্তে মিঠুর ঠোঁট তখন লাল হয়ে গেছে। সেদিন মিঠু একাই বাড়ি ফিরল। রিপা ও রাশ্মি টিটুকে না দেখে অনেক খুঁজল, কিন্তু কোথাও পেল না। মিঠু আর মন্টি নতুন সংসার শুরু করল। ধীরে ধীরে শৈশব, কৈশোরের সঙ্গী টিটু তাদের স্মৃতি থেকে মুছে গেল। কিছুদিন পরে মিঠু মন্টি দম্পতির তিনটি বাচ্চা হলো। কিন্তু কি আশ্চর্য! এদের সবার ঠোঁট লাল রঙের। আসলে মিঠুর নির্মম আচরণে সৃষ্টিকর্তা অসন্তুষ্ট হয়ে সব টিয়ে পাখির ঠোঁটের রঙ লাল করে দিল। এখন তো আমরা সব টিয়ে পাখির ঠোঁট লাল রঙেরই দেখি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে