রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
গল্প

লাউয়ের মাচান

সাঈদুর রহমান লিটন
  ০৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
লাউয়ের মাচান

রান্না ঘরের পাশেই একটি লাউয়ের চারা দেখতে পায় ভানুমতী। লিকলিকে দুই তিন পাতা সবে মাত্র হয়েছে।

ভানুমতী কিছু মাটি নিয়ে তাতে হাত দিয়ে চারার গোড়াটি শক্ত করে দেয়। তারপর চারপাশে কঞ্চি দিয়ে আটকে দেয়। নিয়মিত পরিচর্যা করতে থাকে। লাউয়ের সেই লিকলিকে চারাটি একটা লাউগাছে পরিণত হয় একবার। অল্প অল্প করে জাঙ্গলা দিতে দিতে পুরো উঠোন জুড়ে লাউয়ের জাঙ্গলা হয়ে যায়। জাঙ্গলা অর্থাৎ লাউগাছের মাচান। আঞ্চলিক ভাষায় এটাকে জাঙ্গলা বলে।

ভানুমতী তার প্রকৃত নাম নয়। তার আসল নাম মনোয়ারা রহমান। ভোরের সূর্যের মতো স্নিগ্ধময় আলো বিকরিত হয় তার শরীর থেকে। শান্ত অথচ দীপ্তময়, লাজুক অথচ প্রেমময় এক রমণী। তাই মনের অজান্তেই তাকে ভানুমতী হিসেবে সম্বোধন করি। ভোরের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় সূর্যের মতই সবাইকে বিনা পারিশ্রমিকের সেবা দান। বিরামহীন চলতে থাকে পায়ে পায়ে হাতে হাতে টুকটাক ঘরগৃহস্থালির কাজ। অবিরাম চলতে থাকে রাতে শুয়ের পড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। পুরোবাড়ি তার উত্তাপে উত্তাপিত হয়, তার আলোতে আলোকিত হয় এই সংসার। তাই ভানুমতী নামটি স্থায়ী হয়ে গেছে। প্রকৃত নাম আর বলা হয়ে ওঠে না কখনো।

ভানুমতীর লাউয়ের গাছে ফুল এসেছে। প্রতিটি ফুলের সঙ্গে তার পরিচয় হয়ে গেছে। কোথায় কোন কোণে ফুলটি কেমন হয়েছে, কোনো পোকায় ধরেছে কিনা, কোন ফুলে লাউয়ের গুটি আছে। তার হুবহু মুখস্থ হয়ে গেছে। তার নিয়মিত পদচারণা পড়ে লাউয়ের গাছের মাচানের তলায়। আমার মনে হয় ভানুমতীকে দেখলে লাউগাছরা খুশি হয়। আনন্দ পায়। মনে মনে হাসতে থাকে। দ্রম্নত স্বাস্থ্যবান হয়ে ওঠে। প্রতিটি লাউয়ের ফুলে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিয়মিত পোকানাশক ভেষজ ঔষধ ছিটায়। অপূর্ব সুন্দর, নান্দনিক লাউ গাছ হয়েছে। লাউয়ের মাচান বেয়ে বেয়ে জানান দিচ্ছে তারা যৌবনে পদার্পণ করেছে।

লাউয়ের গাছের রূপ লাবণ্য পাড়ার সব মানুষের মন মানসিকতাকে মোহিত করেছে। প্রতিবেশীরা এক নজর দেখে তাদের নয়ন জুড়িয়ে যায় মাঝে মাঝে। সেদিন মোল্যা পাড়া জামে মসজিদের হুজুর দেখে আলস্নাহর কাছে শোকরানা করলেন আলহামদুলিলস্নাহ বলে।

ভানুমতী মেশিনের মতো চলতে থাকে সারাদিন। ২০/২২টি মুরগি আছে। সারা বছর ডিম পাড়তেই থাকে। আমাদের ডিম কিনতে হয় না কখনো। হাঁস আছে গোটা দশেক। তারাও প্রচুর ডিম পাড়ে। গ্রামের বউ-ঝিরা বাড়ি থেকেই ডিম কিনে নিয়ে যায়। সংসারের চাহিদা মিটিয়ে কিছু টাকাও হয় তার। আমার কাছে হাত পাততে হয় না কখনো। বরঞ্চ আমার অর্থনৈতিক টানাপড়েন দেখলে আনন্দচিত্তে সহায়তা করে। এক অবাক করা সাংসারিক রমণী। ক্লান্তি নেই, অবহেলাও নেই- দিন-রাত ছুটে চলছে সংসারে কোণায় কোণায়। কোথায় কী সমস্যা আছে, কার কী সমস্যা আছে সবকিছু থাকে তার নখদর্পণে। বাড়ির লেবুর বাগান পরিষ্কার করা, তাতে পানি দেওয়া, কোন গাছে আম ধরেছে, কোন গাছে আম পেকেছে- সব তার খবর রাখতেই হবে। বাড়ির ফাঁকা জায়গায় উচ্ছে লাগানো, কয়েকটি বেগুন গাছ লাগানো, ডাঁটাশাক বোনা তার নারীময় কোমল হাতে স্নেহ সুলভভাবে সতেজ হয়ে উঠছে। তার মায়াবী হাতের পরশে আনন্দঘন পরিবেশে প্রকৃতির সঙ্গে পালস্না দিয়ে এসব শাকসবজি আমার বাড়ির উঠোনে হাসতে থাকে সর্বক্ষণ। ভানুমতীর হাসি আর লাউ গাছের হাসি, আর অন্যান্য জীব-অজীবের হাসি সামন্তরালভাবে মিশে যায় প্রকৃতির হাসির সঙ্গে। অসীম ক্ষমতা রমণীর। রমণীদের ছোঁয়ায় ছাই ও সোনায় পরিণত হয়। ভানুমতীর হাত তেমনি একটি হাত যেখানে হাত দেয় সেখানেই সোনা হয়ে লাবণ্য ছড়াতে থাকে।

লাউ গাছে লাউয়ের জালি ঝুলে পড়েছে মাচানের নিচ দিয়ে। কী অপূর্ব দেখতে লাগছে। বিধাতার সমস্ত সৌন্দর্য যেন ঠিকরে পড়ছে লাউয়ের মাচান তলে। ভানুমতী লাউয়ের মাচান তলে প্রতিটি লাউ দেখে আর বিজয়ের হাসি হাসতে থাকে, একাকি, প্রকৃতির সঙ্গে। প্রকৃতি যেন তার নিবিড় বান্ধবী। দু'হাত ভরে দান করে যায় তার সমস্ত আশীর্বাদ।

ভানুমতীর কয়েকটি ছাগল আছে। বাড়ির আশপাশের আগাছা খাইয়ে তাদের পালন করে। প্রতি বছর একটা/দুইটা ছাগল বিক্রি করে। বিরাট একটা অর্থ সংসারে আগমন ঘটে। পুনোর্দ্যোমে চলে তার জীবনযাত্রা। ঝড়, বৃষ্টি, রোদ তাকে দমাতে পারে না। আনন্দ উলস্নাসের মধ্য দিয়ে চালিয়ে যায় তার কর্মযজ্ঞ।

লাউ গাছে অসংখ্য লাউ দুলছে। বাড়ি শুদ্ধ শুধু লাউ দুলনি প্রদর্শন চলছে। সবুজ আর সতেজ লাউ দেখতে এত সুন্দর হয় ভানুমতীর লাউ মাচান ছাড়া বুঝতেই পারতাম না। নিজেরা লাউ খাওয়া শুরু করে দিলাম। নিজের বাড়ি তৈরি হওয়া লাউ তার মজাটাই আলাদা। খেয়ে যেন মন ভরে না। কয়েকজন প্রতিবেশীকে ভানুমতী লাউ দিল। প্রতিবেশীদের সঙ্গে এই সামান্য দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমেই সামাজিকতা গড়ে ওঠে। ভানুমতীর প্রতিবেশীদের মধ্যে এক মধুময় সম্পর্কেও সেতুবন্ধন আছে- যা স্পাত কঠিন। ভানুমতীর লাউ আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি পর্যন্ত সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। বাড়ির ওপর ব্যাপারি ডেকে লাউ বিক্রি চলছে।

ভানুমতী একটি আতমাজলা লাউয়ের চারা থেকে যেন লাউ প্রদর্শনী ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলেছে।

মাচানের সবুজ লাউগুলো ধরে ধরে যখন দেখতে থাকে ভানুমতী তখন তাকে প্রকৃতির কন্যা বলেই মনে হয়। প্রকৃতি আর ভানুমতী যেন আত্মীয়, স্নেহ ভালোবাসায় এক হয়ে যায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে