গল্প

হারিয়ে গেল ঘুড়িটা

প্রকাশ | ৩০ জুন ২০২৪, ০০:০০

আব্দুস সবুর
ঘুড়ি ওড়ানোর খুব শখ ছিল। পাড়ার অন্য ছেলেরাও আমার মতোই ঘুড়ি ওড়াত। রোজ বিকালে আকাশের দিকে তাকালেই দেখা যেত রংবেরঙের ঘুড়ি। লাল-নীল-হলুদ-সাদা আরো কত রঙের ঘুড়ি! আমাদের পাশের গাঁয়ে ঘুড়ির মেলা বসত। তবে আমাদের পাড়ার ছেলেরা কেউ মেলা থেকে ঘুড়ি কিনতো না। নিজ হাতেই ঘুড়ি বানাতে পারত। কেউ কেউ আবার বানাতে পারত না। তবে তাদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কেউ না কেউ ঘুড়ি বানানোর ব্যাপারে অভিজ্ঞ ছিল। যেমন কারো দাদা ভালো ঘুড়ি বানাতে পারত, কারো আবার নানা। কারো বাবা ঘুড়ি বানাতে বেশ পারদর্শী কিংবা কারো বড়ভাই বেশ ভালো ঘুড়ি বানাতে পারে। তাদের মধ্যে কারো থেকে বানিয়ে নিত নিজের পছন্দের ঘুড়ি। আমি তখন ছোট্ট ছিলাম। আমিও পারতাম না ঘুড়ি বানাতে। তাই ভাইয়ার কাছে বায়না ধরে একবার একটি ঘুড়ি বানিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদিন না উড়াতেই নিজের অসতর্কতার কারণে হঠাৎ ডাবগাছের মাথায় আটকে গেল ঘুড়িটা। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই ছুটে যেতাম ডাবগাছের গোড়ায়। তাকিয়ে দেখতাম ঘুড়িটাকে। লক্ষ্য করতাম পড়েছে কিনা। না, ঘুড়িটা পড়েনি। বেশ কয়েকদিন এভাবে ছুটে গেলাম ডাবগাছের গোড়ায় ঘুড়িটা পড়েছে কিনা দেখার জন্য। না, পড়েনি। এরপর দ্বিতীয়বার ভাইয়াকে আর বলার সাহস হয়নি, ঘুড়ি বানিয়ে দেওয়ার জন্য। আমার ভাতিজা। আমার সমবয়সি। আমার চেয়ে দু'চার মাসের বড় হবে হয়তো। ওর নাম রাজিব। কেউ ডাকে রজিব বলে। আবার গ্রামের সাধারণ অশিক্ষিত মানুষজন আরও ব্যঙ্গ করে ডাকে অজিব বলে। আমি তখন ছোট ছিলাম না বুঝে আমিও ডাকতাম অজিব। ও ঘুড়ি বানাতে খুব পটু ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই সুন্দর সুন্দর ঘুড়ি বানাতে পারত। আমি ওর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতাম আর ওর ঘুড়ি বানানো দেখতাম। এভাবে ওর ঘুড়ি বানানো দেখতে দেখতে আমিও শিখে গেলাম কীভাবে ঘুড়ি বানাতে হয় সেই কৌশল। এরপর আমিও নিজ হাতে ঘুড়ি বানাতে লাগলাম। একটা ঘুড়ি বানাই। ঠিকমতো না উড়লে ভেঙে ফেলি। আবার বানাই আবার ভেঙে ফেলি। এভাবে একবার একটি ঘুড়ি বানালাম। ঘুড়িটা বেশ ভলোই। উড়তে লাগল খুব! আমি ওই ঘুড়ি বানিয়ে খুব নাম কামালাম। সবাই বলতে লাগল, এত সুন্দর ঘুড়ি! কে বানিয়েছে রে! আমি মুচকি হেসে বলতাম, আমিই বানিয়েছি। ওরা বলত, বেশ ভলোই তো ঘুড়ি বানানো শিখে গেছিস দেখছি। আমি শুধু মিটমিটিয়ে হাসতাম। এরপর ওই ঘুড়িটাকেই নিয়মিত উড়াতে লাগলাম। ওই ঘুড়িটাকে ভাঙলাম না আর। দিন যায় আর ঘুড়িটার প্রতি আমার মায়া বাড়তে থাকে। বাজার থেকে রঙিন কাগজ কিনে লাগালাম। খুলে ফেললাম পূর্বের কাগজ। এবার ঘুড়িটা দেখতে বেশ চমৎকার লাগল। প্রতিদিন বিকালে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ঘুড়ি উড়াতে লাগলাম। আমি আর অজিব সব সময় একসঙ্গে ঘুড়ি উড়াতাম। তবে আমরা অন্য ছেলেদের থেকে দূরে দূরে থাকতাম। ভয় পেতাম যদি ওদের ঘুড়ি দিয়ে গুঁতো মারে! এত সুন্দর ঘুড়ি যদি ছুটে যায়! ভয়ে সন্তস্ত্র থাকি আমি আর অজিব। আস্তে আস্তে ঘুড়ি ওড়ানোর এক প্রকার নেশা জন্মাল। রৌদ্রে মাঠেও ঘুড়ি ওড়াতাম। মাঝে মাঝে স্কুল ফাঁকি দিয়েও ওড়াতাম। একবার মায়ের বকাও খেয়েছিলাম ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য। অজিব প্রতিদিন বিকালে ঘুড়ি ওড়াত। অন্য সময় ওড়াত না। ওর বাবার সঙ্গে কাজ করত টুকটাক। কিন্তু সেদিন সকালে হঠাৎ অজিব ডাকল, 'রাতুল, দেখ দেখ কত সুন্দর বাতাস। এই বাতাসে ঘুড়ি বেশ ভালো উড়বে। চল তোর ঘুড়ি বের করে আন আমি আমারটা নিয়ে আসছি।' বলেই ওদের ঘরে ঢুকল। আমিও ওর কথা মতো আমার ঘুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর দুজনে একসঙ্গে ঘুড়ি উড়িয়ে দিলাম। প্রবল বাতাসে ঘুড়ি দুটো বেশ ভালোই উড়ছিল। অজিব বলল, 'আজ নাটাইয়ের সবগুলো সুতোই ছেড়ে দেব।' ওর কথায় আমার ছোট্ট মন ধড়ফড়িয়ে উঠল। নিমিষেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠলাম, 'আমিও সব সুতো ছাড়ব।' যা হওয়ার হবে আজ। তারপর দু'জনে একসঙ্গে ছাড়তে লাগলাম সুতা। আর ঘুড়িও উড়তে লাগল অনেক উপরে। কিন্তু সুতা ছাড়তে ছাড়তে দেখি আমার ঘুড়িটা উড়ে উড়ে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। নাটাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি কোনো সুতা নেই তাতে। সুতার মাথা নাটাইয়ের সঙ্গে বাঁধা নেই। একথা আমার মনে ছিল না। যে কারণে আমার ঘুড়িটা ছুটে চলে গেল। আমি দৌড়াতে লাগলাম। আমার সঙ্গে সঙ্গে অজিবও ছুটতে লাগল। বেশ কিছুদূর দৌড়ানোর পর হাঁপিয়ে গেলাম আমরা। ধরতে পারলাম না ঘুড়িটাকে। হারিয়ে গেল ঘুড়িটা। নিমিষেই আমার মুখ কালো হয়ে এলো। অজিব বলল, 'আমি তোকে আরেকটি ভালো ঘুড়ি বানিয়ে দেব। চিন্তা করিস না।' দুয়েক দিনের মধ্যে অজিব আরেকটি ঘুড়ি বানিয়ে দিল। যা আমার হারিয়ে যাওয়া ঘুড়ির চেয়েও ভালো ওড়ে। কিন্তু তবুও কেন জানি আমার হারিয়ে যাওয়া ঘুড়িটার কথা মনে পড়ত। আজও মনে পড়ে সেই ঘুড়িটার কথা।