তুতুনের মন ভালো নেই। তার আদরের লালুকে আজ কোরবানির উদ্দেশে জবাই করা হবে। তাই সে কান্না করছে। সে এই লালুকে উপহার হিসেবে পেয়েছিল মামার বাড়ি থেকে।
আজ থেকে তিন বছর আগে। একদিন তুতুন তার আম্মুর সঙ্গে নানুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। তখন তার বয়স চার বছরের কাছাকাছি। সবে তার মুখে কথার খই ফুটতে শুরু করেছিল। নানুর বাড়িতে যেয়ে কী হৈ-হুলেস্নাড়! খুশির যেন অন্ত নেই। নানুও তাকে পেয়ে ভীষণ খুশি। একমাত্র মেয়ের প্রথম নাতি। আদরের কোনো কমতি রাখেনি। মামারাও তাকে অনেক আদর করেছে। এই দুই দিনে নানুর পরম আদর, সোহাগ ও স্নেহ পেয়ে বাড়ি ফিরতে চাচ্ছিল না। কিন্তু বাড়ি না ফিরলে কী হবে? অতপর, বাড়িতে রওনা হবে। তখন বড় মামা প্রথা অনুযায়ী একটা ষাঁড় বাছুরসহ গাভী ধরিয়ে দিলেন তার হাতে। আর বললেন, মামা এটা তোমার জন্য উপহার। তুতুন খুশিতে নাচতে শুরু করে।
এই গরু বাড়িতে নিয়ে সে ষাঁড় বাছুরের একটা নাম দিল। লালু। এই লালুই হয়ে ওঠে তার খেলার সাথী। সবসময় তার পিছেই পড়ে থাকে। বাবার সঙ্গে যেয়ে ঘাস এনে খাইয়ে দেয়। কলা খাওয়ায়। আম-কাঁঠাল খাওয়ায়। গোসল করিয়ে দেয়। এভাবেই তার আরও তিন বছর পেরিয়ে যায়। লালু হয়ে ওঠে অনেক বড়। তুতুন যদি বলে লালু এদিকে এসো। চলে আসে। যদি বলে ওদিকে যেও না। যায় না। লালু হয়ে ওঠে তুতুনের পরম বন্ধু। স্কুল থেকে এসে প্রথমেই লালুকে পানি পান করতে দেয়। একটু ঘাস বা লতাপাতা দেয়। লালু তার পেছনে পেছনে লাফালাফি করে। তার এই শিশুপনা আর পশুর প্রতি ভালোবাসা আব্বু-আম্মুর কাছে খুবই ভালো লাগে।
সামনে কোরবানির ঈদ। ঘরে আব্বু-আম্মু পরামর্শ করছে। এবারের কোরবানিতে কী গরু কিনবে এই নিয়ে। হঠাৎ আম্মু বলল, দেখ তুতুনের বাপ! আলস্নাহ তা'আলা তো সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কোরবানি করলে বেশি খুশি হোন। তাহলে আমরা আমাদের আদরের লালুকে কোরবানি করে দেই! এতে আমি আশাবাদী আলস্নাহ অনেক খুশি হবেন। কারণ, এটা আমাদের সবচেয়ে খাহেশের প্রাণী। প্রথমে আব্বু তুতুনের দিকে তাকিয়ে রাজি হতে চাচ্ছিল না। পরে চিন্তা করল, বাছুর তো পরে ক্রয় করা যাবে। কিন্তু এই সুযোগ আর পাবে কি-না এর কোনো গ্যারান্টি নেই। তাই শেষমেশ রাজি হয়ে গেল।
আজ ঈদের দিন। তুতুনকে জানানো হলো, তোমার লালুকে আমরা কোরবানি করব আলস্নাহর সন্তুষ্টির জন্য। তুমি কী এতে রাজি আছ? কারণ, আলস্নাহ বলেছেন, তোমরা সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কোরবানি কর। এতে আমার সন্তুষ্টি রয়েছে। তুমি কী আলস্নাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চাও? তুতুন কোমলপ্রাণ শিশু। আলস্নাহর সন্তুষ্টির কথা শুনে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু এরপর থেকে তার শরীরে কেমন ছটফট শুরু হয়েছে। একটু পরপর লালুর কাছে যায়। জড়িয়ে ধরে কান্না করে। তার কান্না দেখে আম্মুর চোখের পানি আটকে রাখতে পারে না। আম্মুও কান্না শুরু করে।
ঈদের নামাজ শেষে যখন তুতুনকে শেষবারের মতো লালুর সঙ্গে দেখা করাতে নেওয়া হয়, তখন তুতুন চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করে। আর বলতে থাকে, না, আমার লালুকে জবাই করতে দেব না। তোমরা আমার লালুকে জবাই করো না! অনেক কাকুতি-মিনতি করে। তুতুন লালুকে জড়িয়ে ধরে। আর ছাড়ে না। লালুর চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ঝরছে। সে বোবা প্রাণী। তার কথা বলার শক্তি নেই। কিন্তু ইশারায় অনুভব করা যায় তার মনের আকুতি। তার চোখের জল বলে দিচ্ছে সেও জবাই হতে চায় না। তবুও আলস্নাহর সন্তুষ্টির জন্য তাকে জবাই হতে হবে। তুতুনের কান্না দেখে আশপাশের লোকজন কান্না করছে। তুতুনকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই থামছে না। অবশেষে টেনেহিঁচড়ে জোর করে ঘরে নিয়ে যায় আব্বু। এদিকে লালুকে জবাই করা হয়ে গেছে। তুতুন একটু পরপর ফুপিয়ে-ফুপিয়ে কান্না করছে। তার অন্য বন্ধুরা তাকে দেখতে আসছে। কাউকেই সহ্য হচ্ছে না তার। ঈদ যেন শোকের দিনে পরিণত হয়েছে তার কাছে। সে শুয়ে আছে। মন ভালো নেই।