অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এই সোনার বাংলাদেশ। এ দেশ ধানের দেশ, গানের দেশ, বীরের দেশ, কবির দেশ। সবুজ শ্যামল বাংলার রূপ প্রকৃতি প্রত্যেক কবিকেই হাতছানি দিয়ে ডেকেছে বারংবার। তেমনি আমাদের জাতীয় কবি, দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, শিশুতোষ কবি, কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ, ইংরেজি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে তৎকালীন বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের পর থেকেই নানা দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন কবি। মাত্র আট বছর বয়সে কবি পিতৃহারা হন। তারপর থেকে কবি কখনো রুটির দোকানে কাজ করেছেন, কখনো বা লেটোর দলে কাজ করেছেন। বিচিত্র এই জীবনে কবি প্রতিভার যে উন্মেষ ঘটেছে তা আমরা তার রচনাবলিতেই দেখতে পাই। বড়দের পাশাপাশি তিনি ছোটদের জন্য লিখেছেন দু'হাত ভরে। কবির হাতের ছোঁয়ায় শিশু সাহিত্যের প্রতিটি শাখা পূর্ণ হয়ে উঠেছে। ছোটদের জন্য তিনি বেশকিছু কাব্যগ্রন্থ এবং একটি নাটক রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে ঝিঙে ফুল, পুতুলের বিয়ে, ঝড় এবং পিলে পটকা উলেস্নখযোগ্য। তিনি ছোট-বড় সবার প্রিয় কবি। সবার জন্যই লিখেছেন। ছোটদের মেধা ও মনন উপযোগী মজার মজার অনেক লেখায় সমৃদ্ধ করেছেন শিশু সাহিত্যকে। শিশুদের ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছা জাগিয়ে তুলেছেন কবি নজরুল। তাদের মনের কথা, মান-অভিমানের কথাগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন সুনিপুণভাবে।

শিশুদের চঞ্চল মন কী চায় তার একটি পরিষ্কার ছবি বিদ্যমান কবির কবিতায়। কাব্যিক শৈলীতে কবির শিশুতোষ কবিতাগুলো ছোট-বড় সবারই মন কাড়ে। সকালবেলা বা প্রভাতে ঘুম থেকে ওঠা একটি ভালো অভ্যাস। সেই সকালবেলা ওঠা নিয়ে কবি লিখেছেন প্রভাতি নামক কবিতা। এই কবিতার মধ্য দিয়ে শিশুদের কথা বা শিশুদের অভিভাবকদের কথা ফুটে ওঠে। তিনি বলেছেন :

'ভোর হোলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠ রে!/ঐ ডাকে জুঁই-শাখে ফুল-খুকি ছোট রে! খোকা সকালবেলার পাখি হতে চায়, কিন্তু সেখানে বাদ সাধে তার মা। তার মা সকালে খোকাকে উঠতে দিতে চায় না, মা বলে এখনো সকাল হয়নি ঘুমিয়ে থাকো। আরো পরে ঘুম থেকে উঠো। তাই খোকা মাকে আলসে মেয়ে বলেছে। খোকা তার মাকে এও বোঝানোর চেষ্টা করেছে আমরা জাগলেই তবে সকাল হবে। তাই কবি প্রভাতি কবিতায় লিখেছেন : আমি হব সকাল বেলার পাখি। কিশোর মনে নানা কিছুর ভাবনা আসে। কিশোর মনে নানা ভাবের উদ্রেক হয়। শিশুদের অদম্য ইচ্ছাকে সুন্দররূপে ফুটিয়ে তুলেছেন সংকল্প কবিতায়। তিনি লিখেছেন : থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে। তাছাড়া শিশুতোষ ছড়া কবিতা কাঠবিড়ালি, লিচুচোর ইত্যাদি তার অজেয় রচনা। বাংলা সাহিত্যের শিশুতোষ শাখাটি কাজী নজরুল ইসলামের কোমল হাতের স্পর্শে পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার কবিকে সপরিবারে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং সরকারিভাবে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৬ সালে কবিকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় এবং তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। তিনি আমাদের জন্য যে অমূল্য সাহিত্যসম্ভার রেখে গেছেন তা আমাদের জন্য সত্যিই গর্বের। কাজী নজরুল ইসলামকে জানার জন্য তার লেখা সাহিত্যকর্ম আমাদের বেশি বেশি করে পড়তে হবে। পাঠক মনের মণিকোঠায় কবি বেঁচে থাকবেন চিরকাল। আমাদের জাতীয় ও প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১২ ভাদ্র, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ এবং ইংরেজি ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ সালে ৭৭ বছর বয়সে মৃতু্যবরণ করেন। তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে দাফন করা হয়। আমাদের প্রিয় কবির প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।