এক
যখন আমি বড় হবো; সেদিন 'দেকপা মা এই এত এত গোস্ত নিয়ে আসপো, পোল্টির গোস্ত না মা। খাসির গোস্ত, তুমি অভিমান করে কবা- এই এত গোস্ত রান্দা যায়? পাগল ছেলে আমার! আমি কবো বেশি বেশি তেল মশলা দিয়ে রান্দো মা, আর থাল ভরা সাদা গরম ভাত নিয়ে আসোদিনি.... তকন দেকপা আমাগের সপ দুকখো ফুড়ুত করে কনে জানি উড়ে গিয়েচে। তুমি দেকে নিয়ো।'..... আরো কত কথা বলতে থাকে রাখাই। মা আমিনা বেগমের চোখে পানি এসে যায়। আঁচলে আড়াল করে বলে, 'আমার বাপ যকন বড় হবে, তকন আর কিচুই লাগবেনানে, শুধু আমার বাপ যেন মানুষির মতন মানুষ হতি পারে এই চাই, আর কোনো কিচুর দরকার নেই।'
- মাগো, আর এট্টু কচু শাক দিবা? বড্ড মজা হয়েচে।
- ওমা ওকি কতা? দোবোনা ক্যানে? নে বাপ, খা না। তোর আব্বা যদি বেঁচে থাকতো তবে কি আর এই দিন দেকা লাগে..!
আমিনা বেগম এবার আর নিজেকে সামলাতে পারে না। ডুকরে কেঁদে ওঠে। মাকে জড়িয়ে ধরে রাখাই। তার ঠোঁট ফুলে ফুলে ওঠে, চোখ ভিজে যায়।
দুই
- মাগো চৌধুরীগের বাড়ি যাবা? বিকেলে নাকি শাড়ি দেবে, বিটা মানষির লুঙ্গি আর সব্বার জন্যি একশো টাকা। যাবা?
- না বাজান, আমার শরীরটা ভালো না। কোনো কিচু ভালস্নাগে না।
: আমি যাই?
: না রে বাপ, অত ভিড়, কত মানুষির চিলস্না ফালস্না, হুড়োহুড়ি। তাছাড়া, চৌধুরীর লোকজন ভালো না। কথায় কথায় লাঠি ছুড়ে মারে, গালাগালি করে।
-ও! কচ্চিলাম আমি যদি একা যাই? তুমার জন্যি শাড়ি আনতি পারতাম। আর একশো টাকা দিয়ে খাবার কিচু আনতাম, তা না হলি তুমার অষুদ কিনতি পারতাম! আমি তো একা না মা, ফুলি বুরাও যাবে, আছর বাদ। যাব মা?
- মনেতো সায় দেয়নারে বাপ। তুই ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই, তোর কিছু হয়ে গেলি আমি যে বাঁচপোনারে সুনা।
- ঠিক আচে মা। তুমি না বলেচো মানে না।
তিন
মা আমিনা বেগমের পুরানো কাশিটা বেড়েছে। গায়ে জ্বর, সারা শরীরে ব্যথা, গায়ে কোনো বল নেই। বিরেন ডাক্তারের লাল সিরাপে আর কাজ হয় না। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার আপা নতুন ট্যাবলেট, আর ক্যাপসুল লিখেছেন। অনেক দাম। এত দাম দিয়ে অষুধ কেনা কি করে সম্ভব? আজ সাতদিন কোনো কাজ করতে পারেনি মা। রাখাই মাকে বলে-
- চিন্তা কোইর না মা, সপ ঠিক হয়ে যাবে। আমি এট্টু বাইরে যাচ্চি। বিষুর সাতে।
- কুতায় যাচ্চিস বাপ?
- পরে কবানি মা। তুমার প্রেসক্রিপশনডা নিয়ে গেলাম। কিচু লাগলি রাহেলাকে ডেকো। খালাকে বলে রাকিচি। একন যাই মা।
\হমায়ের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। কোথায় যাবে ছেলেটা? অতটুকু মানুষ কি করবে ও? নাহ্ ভেবে কুল কিনারা পায় না মা। এদিকে দুর্বল শরীর নুয়ে পড়ছে। বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে আমিনা বেগম। আজ খুব রাখাইয়ের বাবার কথা মনে পড়ে। লোকটা থাকলে আজ আর এই দিন খেতে হ'তনা। ছেলেটাকে নিয়ে বাড়ি মাথায় করে রাখতো মানুষটা। আর আমিনাকে কখনোই পরের বাড়িতে কাজ করতে দিত না।
পুরান ঢাকার জুতোর কারখানাতে কাজ করত রাখাইয়ের বাপ আবুরালি। মরার আগুনে এক দুপুরবেলা ফ্যাক্টরি পুড়ে কয়লা। আবরালি তখন ভেতরেই ছিল। ফোনে শুধু বলেছিল-
- দোয়া কোরো রাখাইয়ের মা। আর হয়তো দেখা হবে না। পুড়ে কয়লা হওয়া একটা লাশ আর পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে গিয়েছিল মালিকের লোকজন। আহারে কপাল...! তার বন্ধুরা সবাই বেঁচে আছে। আজো সেই কারখানায় কাজ করে।
চার
রাখাই্ের ডাকে হুড়মুড় করে উঠে বসে মা। ক্লান্ত দুর্বল শরীরে ঘুমিয়ে
পড়েছিল সে।
- মা, ও মা, এই শাড়িটা পচন্দ হয়েচে? ঈদের দিন পরবা। পরলি তুমার কিন্তু অন্যরকম লাগবে। পরীর মতো লাগবে। আর এই তুমার অষুদ। আর এই প্যাকেটে ছুলা, বেগুনি, মুড়ি... মানে তুমার ইফতার। আমি কলাম না সপ ঠিক হয়ে যাবে। তুমিও ভালো হয়ে যাবা মা।
- তুই এত সপ..
- চুরি করিনি মা। চৌধুরীর দানও না। বিষুভাই আর আমি সারাদিন ঠেলাগাড়ি ঠেইলে এসব কিনিছি মা। এবার বলো আমি কি তুমার ছোট্ট এইটুক ছেলে?
মা কিছু বলতে পারে না। আনন্দে আবেগে চোখে পানি এসে যায়। রাখাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদতেই থাকে, কাঁদতেই থাকে। বস্তির পশ্চিমাকাশে তখন ঈদের চাঁদ এসে দোল খায়, সে আলোর খুশি ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিক। মায়ের হাসিতে ম্স্নান হয়ে যায় রাখাইয়ের ছোট্ট হাতের অসংখ্য কালশিটে দাগ, সারাদিনের অমানুষিক পরিশ্রম।