একটা বছর ঘুরে ঈদ আসে। এই ঈদকে উপলক্ষ করে সবাই কত কী করে। কেউ দাদুবাড়ি যায়, কেউ নানুবাড়ি যায়। কেউ-বা শহরেই থাকে। কিন্তু প্রত্যেকেই ঈদে নতুন
জামা-কাপড় কেনে। ঈদে নতুন জামা-কাপড় না কিনলে যেন ঈদকে ঈদ-ই মনে হয় না।
মাঝেমধ্যে এমনও মনে হয়, নতুন জামা-কাপড় কিনতেই মনে হয় ঈদ আসে। সেই যাহোক, এবার ঈদে টুনি দাদুবাড়ি যাবে। সে কী উচ্ছ্বাস, কে কী আনন্দ! মনে হচ্ছে যে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে আর টুনি প্রথম হয়েছে। না, তার চেয়েও বেশি আনন্দ টুনির। আর আনন্দ হবেই না বা কেন, সেই যে গত বছর ঈদে দাদুবাড়ি গিয়েছিল, আবার এই ঈদে যাবে। একটা বছরের অপেক্ষা। এই একটা বছরে কত কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। টুনির দাদুর মাথার যে কটা চুল কাঁচা ছিল, নির্ঘাত এই এক বছরে পেকে সাদা হয়ে গেছে। টুনি দাদিরও যে আরও দুটো দাঁত পড়ে যায়নি, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সে যাহোক, ঈদ ঈদ করে টুনি তো কয়েক সেট ঈদের জামা-কাপড় কিনে ফেলেছে ইতোমধ্যে। বাবার কাছ থেকে নিয়েছে লেহেঙ্গার সেট, আম্মুর কাছ থেকে নিয়েছে ইন্ডিয়ান ফ্রক আর কাকুর থেকে নিয়েছে পদ্মজা ড্রেস। শুধু এখানেই ক্ষান্ত না সে, পস্ন্যান করে রেখেছে দাদুবাড়ি গিয়েই দাদুর কাছে বায়না ধরবে নতুন আরেক সেট ড্রেস কিনে দেওয়ার জন্য। এই তো সেদিন দাদুর সঙ্গে টুনি মোবাইলে কথা বলছিল।
ওপাশ থেকে দাদু যখন জিজ্ঞেস করলেন, 'টুনি দাদুমনি, ঈদে তুমি কী কী কিনলে?'
টুনি দিব্যি মিথ্যা করে বলল, 'দাদুভাই, আমি এখনো কিছুই কিনিনি। আমি ভেবেছি, গ্রামে গিয়ে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে ঈদের শপিং করতে যাব।'
দাদুও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না। তাই তিনি রসিকতা করে বলেন, 'ও আচ্ছা, আমাকে বুঝি নতুন পাঞ্জাবি কিনে দেবে।'
'না, না দাদু, আমি নতুন ড্রেস নিব। তুমি কি কিনে দিবে না?'
'অবশ্যই দিব। আমি তোমাকে নতুন ড্রেস কিনে দিব আর তুমি আমাকে একটা পাঞ্জাবি কিনে দিবে। কেমন?'
'আমার টাকাই নেই, দাদু। তাই তোমার কাছে আসছি। আর তুমি কিনা উল্টো বলছ। বলো তো এখন কী উপায়?'
'উপায় হবেই হবে। তুমি এত দুশ্চিন্তা করো না, দাদুমনি। তুমি দ্রম্নতই গ্রামের বাড়ি চলে আসো। তোমার দাদি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।'
'এই তো দাদুভাই, শীঘ্রই চলে আসব। এসে তোমাকে সারপ্রাইজ দিব। কেমন?'
টুনি দাদুকে কী সারপ্রাইজ দিবে, নিজেই ক'দিন ধরে সারপ্রাইজড হয়ে যাচ্ছে।
না মানে ঈদের ড্রেস কেনা নিয়ে নয়, স্কুল ছুটি হওয়া নিয়ে। এই তো রমজান মাস শুরু হওয়ার আগে ক্লাসে রিনা ম্যাডাম জানিয়েছিলেন, 'রমজানের প্রথম দিন থেকেই স্কুল বন্ধ দেওয়া হবে।' আর এখন কিনা শোনা যাচ্ছে অন্য কথা যে রমজানেও ক্লাস হবে, স্কুল খোলা থাকবে। এ কেমন কথা!
কথা যেমনই হোক, এ নিয়ে না কি হাইকোর্টে রিটও হয়েছে। রিট পিটিশন জানিয়েছে, পুরো রমজান স্কুল বন্ধ থাকবে না। ভাগ ভাগ করে স্কুল বন্ধ দেওয়া হবে।
মানে প্রথম দশ রমজান পর প্রাইমারি স্কুল বন্ধ দেওয়া হবে আর পনেরো রমজান পর হাইস্কুল বন্ধ দেওয়া হবে। ভাগ্য ভালো টুনির। সে এখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে
পড়লেই তাকে পনেরো রমজান পর্যন্ত ক্লাস করতে হতো।
এদিকে ছুটি নিয়ে হট্টগোল-গন্ডগোল, ওদিকে টুনির বাবা তো আরেক কান্ড ঘটিয়ে রেখেছেন। টুনির আম্মু ভেবেছে গত বছরের মতো এবারও রমজানের প্রথম দিন থেকেই স্কুল বন্ধ থাকবে। আর রিনা ম্যাডামও তেমনটাই বলেছিলেন। তাই রমজানের দশ দিন আগেই ট্রেনের তিনটা এসি টিকিট কেটেছে রেখেছে টুনির বাবাকে বলে। ট্রেনের আবার উটকো নিয়ম, দশ দিন আগে টিকিট না কাটলে কোনো সীট পাওয়া যায় না। এখন তো ছুটির নানান নিয়মের কথা শুনে টুনির আম্মুর মাথায় বাজ। টুনি ওর আম্মুকে জিজ্ঞেস করে, 'আম্মু, আমরা যা ভাবলাম, তা তো হলো না।'
প্রথম রমজানে স্কুল বন্ধ হবে ভেবে তুমি অগ্রিম ট্রেনের টিকিট কাটলে, এখন স্কুল তো বন্ধ দিবে দশ রমজান পর। কী করবে?'
'দেখি কী করা যায়। ট্রেনের টিকিট তো সোনার হরিণ। তাও আবার এসি টিকিট।
এই টিকিট মিস করলে এবার আর ঈদের মধ্যে বাড়ি যাওয়া হবে না। যা করাই হোক না, টিকিট বাতিল করা যাবে না।'
'তাহলে কি স্কুল ছুটি নিবে, আম্মু?'
'হুম, স্কুল দশ দিনের অতিরিক্ত ছুটি না নেওয়া ছাড়া তো কোনো উপায় দেখছি না, টুনি।'
'কিন্তু আমাদের ক্লাস কো-অর্ডিনেট ম্যাডাম যে বদমেজাজি, তিনি এত ছুটি দিবেন না। বলবেন, ঈদের ছুটি পঁচিশ দিন। আবার আরও দশ দিন অতিরিক্ত। এত ছুটি দিলে বাচ্চাটা উচ্ছন্নে যাবে। পড়াশোনো সব বেচে খাবে। এবার পিইসি পরীক্ষা দিতে হবে। এতদিন ক্লাস না করলে রেজাল্ট খারাপ করবে। রেজাল্ট খারাপ হলে স্কুলের দুর্নাম হবে। স্কুলের দুর্নাম হলে ছাত্রছাত্রী ভর্তি কমে যাবে। ছাত্রছাত্রী ভর্তি কমে গেলে ম্যাডামদের বেতনও কমে যাবে।'
'দেখা যাক, কী হয়। আমি আগামীকাল তোমার সঙ্গে স্কুলে যাব। তোমাকে ক্লাসে দিয়ে আমি ক্লাস কো-অর্ডিনেট ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলব। ছুটি না নিতে পারলে এবার ঈদে বাড়ি ফেরা কঠিন হয়ে যাবে। গ্রামের বাড়ি আর ঈদ করতে হবে না।'
টুনির আম্মুর যা ভাবনা, তাই করা। টুনিকে নিয়ে পরদিন স্কুলে আসেন। টুনি ক্লাসে গেলে টুনির আম্মু ক্লাস কো-অর্ডিনেট ম্যাডামের রুমে গিয়ে ঘটনার পুরোপুরি খুলে বলেন। ম্যাডাম এটা শুনে থ। এতদিন একজন ছাত্রী কীভাবে ছুটি কাটায়। তিনি ছুটি দেবেনই না। একদম অনড়। তার একটাই কথা, সরকারি ছুটির আগে কোনো ছুটি নয়। এদিকে টুনির আম্মুও নাছোড়বান্দা। তিনিও নানান লজিক দিতে থাকেন। বলেন, 'ম্যাডাম, এখন ডিজিটাল যুগ। আমি আপনার সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন জেনে নিব।'
'তা না হয় জেনে নিলেন, প্রতিদিনের হোমওয়ার্ক কীভাবে দেখাবেন?'
'আহ ্ ধসঢ়; ম্যাডাম, এজন্যই বললাম হোয়াটসঅ্যাপের কথা। টুনি হোমওয়ার্ক করবে, আমি ছবি তুলে আপনাকে পাঠাব। আপনি দেখে দেবেন। আমিই টুনিকে বাসায় পড়াব।'
'আপা, ছুটিতে গ্রামে গেলে বাচ্চারা যে কতই পড়ে, তা আমরা জানি।'
'ম্যাডাম, টুনিকে নিয়ে আপনার এত দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি ওকে ঠিকঠাক পড়াব।'
'আপনি টিচার হলেই পারতেন, আপা।'
'যা বলেছেন না, ম্যাডাম। সংসারের ঝুটঝামেলা না থাকলে আর আপনার ভাইয়ার একটু আগ্রহ থাকলে নিয়ে নিতাম টিচারের চাকরিটা।' কথা বলতে বলতে টুনির আম্মু টুনির ছুটির দরখাস্তটা ক্লাস কো-অর্ডিনেট ম্যাডামকে দিয়ে দেন।
ম্যাডাম আর কী করবেন। যেহেতু টুনিদের ট্রেনের টিকিট কাটা হয়েই গেছে, তাই তিনি আর না করতে পারেন না। টুনির দশ দিনের ছুটি মঞ্জুর করে দেন।
স্কুল থেকে ফিরে টুনি যখন জানতে পারে তার ছুটি মঞ্জুর করেছেন ক্লাস কো-অর্ডিনেট ম্যাডাম, তখন যেন তার আনন্দের আর সীমা নেই। আগামী শুক্রবার মানে আর দু'দিন ক্লাস করার পরই সে রওয়ানা দিবে দাদুর বাড়ি। এ কথা ভাবতেই টুনির মনের ভেতর যেন ঈদ বয়ে যাচ্ছে। কী মজা, ঈদের ছুটিতে দাদুবাড়ি
যাচ্ছে টুনি।