সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
গল্প

রথির একুশ

মিতুল সাইফ
  ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
রথির একুশ

ডালে ডালে দোল খাচ্ছে পলাশ শিমুল। কোয়েলের কুহু কুহু কলরোল শোনা যাচ্ছে থেকে থেকে। শীতের দাপট কমে গেছে। এ এক উদাস করা বসন্তকাল। ফেব্রম্নয়ারি, আমাদের ভাষার মাস। সালাম, রফিক, শফিক, বরকত, জব্বার আরও নাম না জানা ভাইয়েরা এ মাসেই বাংলা ভাষার দাবি আদায়ে শহীদ হয়েছিলেন। ফেব্রম্নয়ারি মাস এলেই মনটা অন্যরকম হয়ে যায় রথির। উদাস হয়ে জানালায় বসে থাকে, ছাদে উঠে হাঁটাহাঁটি করে। বাড়ির ছাদে করা বাগানে ফুলগাছেদের যত্ন নেয় আর মনে মনে বলে- ফুল, কত সুভাগ্য তোদের; শহীদ ভায়ের জন্য মালা হতে পারিস তোরা! ইস! আমি ফুল হলেও এইভাবে মালা হয়ে ঝুলে থাকতাম শহীদ মিনারের বুকের মধ্যে।

আরও কত কথা যে হয়, ফুলেদের সঙ্গে, তা বলতে গেলেতো অনেক অনেক সময়ের ব্যাপার। তবে সব সুখ-দুঃখের কথা রথি ফুল, পাখি আর গাছের সঙ্গে ভাগ করে নেয়। মা-বাবাকেতো সব সময় পাওয়া যায় না। সেই অত ভোরে উঠে রথির স্কুল, আর মা-বাবার অফিস। স্কুল বাসে বাড়ি ফিরে শুধু বুয়া-খালামনিকে কাছে পাওয়া যায়।

\হমা বলে, জীবন এটাই। বাঁচতে হলে এভাবেই কঠিন সংগ্রাম করে চলতে হয়। অত কঠিন কথা বোঝে না রথি। শুধু বোঝে এভাবেই থাকতে হবে। দাদুর কাছে শুয়ে ভাষা আন্দোলনের অনেক ইতিহাস শুনেছে সে। স্কুলের বই থেকেও জেনেছে কিছু কিছু। মনে মনে শহিদ ভাইদের জন্য এক অন্যরকম মমতা তৈরি হয়েছে তার। কিন্তু ওই একদিনেই কেন শহীদ মিনারে মালা দেয় সবাই? আর ফেব্রম্নয়ারি মাসেই কেন এত বাঙালিয়ানা দেখাবে সবাই? ভালোবাসা, শ্রদ্ধা কি শুধু কোনো বিশেষ দিনের জন্য হয়? না। ব্যাপারটা কিছুতেই মানতে পারে না সে। আর তাইতো ঈদের দিনে, নিজের জন্মদিনেও শহীদ মিনারে ফুল দেয় রথি। ক্লাসে বন্ধুরা এ নিয়ে হাসাহাসি পর্যন্ত করেছে। কিন্তু কান দেয়নি মেয়েটা।

রথির শুধু মনে হয় ভালোবাসা কেন একদিনের জন্য হবে? ২১ ফেব্রম্নয়ারির পরে কেউ যেন আর এ নিয়ে ভাবেই না। অথচ একুশ এলেই মায়ের ভাষার জন্য সবাই ব্যতি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দাদুর সঙ্গে এসব নিয়ে কতবার কথা বলেছে সে। নাহ্‌! সবাই যেন কেমন!

এবার বাবাকে বলে প্রভাতফেরিতে ঠিক যাবেই যাবে। 'তুমি ছোট মানুষ, ভিড়ের মধ্যে যদি হারিয়ে যাও!' এসব কথা আর শুনবে না সে। হারিয়ে গেলে যাব, তবু যাবই যাব। প্রভাতফেরিতে আর শহীদ মিনারে ফুল দিতে। দাদুও তার সঙ্গে একমত। কিন্তু মা আর বাবাটা একেবারেই কথা শুনতে চায় না। এটাই যত দুঃখ। রথির ঘরের জানালায় একটা শালিক পাখি এসে রোজ এদিক ওদিক তাকায়, কারো সাড়া পেলেই উড়ে চলে যায়, কিন্তু রথিকে দেখে পালিয়ে যায় না পাখিটা। রথি পাখিটাকেও নিজের সব কথা বলেছে। বোঝে না বুঝুক চুপ করে বসে সে শোনে তো, মাথা নাড়ে। কিন্তু বাবা-মা তো কোনো কথা শুনতেই চায় না।

একুশে ফেব্রম্নয়ারির আরও কিছু দিন বাকি। এরই মধ্যে বড় মামা এসে হাজির। রথির আনন্দ আর ধরে না। বড় মামা এলে মা একেবারে চুপ মেরে যায়। মামা তো মায়ের বড়, তাই মামার কোনো কথাতেই আর সে আপত্তি করতে পারে না। কিন্তু এবারে মামাকে অন্যরকম দেখা গেল। সেই হাসি হাসি মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে আছে।

মামা মুখ ভার করে বললেন, 'বাঙালি আর বাঙালি নেইরে! সব যেন কেমন হয়ে গেছে। আসার পথে দেখলাম কারা জানি চলন্ত বাসে আগুন দিয়েছে, ট্রেনেও আগুন দিয়েছে। মা শিশুসহ অনেকেই জীবন্ত লাশ হয়ে গেল। কারা এসব করেছে? তারাতো এ দেশেরই মানুষ এবং বাঙালি। তবে? কি হলো! বড় গর্ব ছিল আমার; এই বাঙালিকে নিয়ে!' মামা চোখ মুছলেন। রথি বড় মামার কথা বুঝলো কিছুটা। তাতেই তারও খুব মনটা ভেঙে গেল।

দাদু বললেন, 'যারা এসব করে তারা কি মানুষ? আমার মনে হয় না। এরা সন্ত্রাসী, সুবিধাবাদি। এদের জন্য বাঙালি জাতিকে নিয়ে গর্ব হাওয়ার কি আছে!

মামা হাতমুখ ধুয়ে বড়ঘরে বিশ্রাম করতে চলে গেল। তারপর দিন গড়িয়ে রাত গড়িয়ে এলো মহান একুশের দিন। ছুটির দিন থাকায় মা-বাবার ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি হয়ে গেল। কিন্তু কোথাও রথিকে পাওয়া গেল না। দাদু আর মামা শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে এসে রথিকে আর দেখেনি। অত ভোরে শীতে কষ্ট পাবে বলে মা-বাবাও তাকে ঘুম থেকে ডাকেনি ফুল দিতে যাওয়ার সময়। তবে? কোথায় গেল মেয়েটি?

না। কেউ জানে না। কেউ বলতে পারে না। কতজনকে ফোন করা হলো। না! কেত্থাও নেই। ঘরের বারান্দায় দাদু পায়চারি করতে লাগলেন। মায়ের চোখ ভিজে গেল। বড় মামা থানা, হাসপাতাল স্টেশনে, স্কুলে খোঁজ নিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন। মহাচিন্তায় পড়ে গেল সবাই। রথির প্রিয় সেই শালিক পাখিটাও মন মরা হয়ে এ ডালে ও ডালে ছট ফট করতে লাগল।

হঠাৎ পাড়ার একুশের মঞ্চে শোনা গেল- এবার মহান একুশের গান গাইছে আমাদের ছোট্ট বন্ধু রথি। রথি গাইল... আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...। আনন্দে সবার চোখে জল এসে গেল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে